আজ বাইশে এপ্রিল সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটর গেলরড নেলসন ১৯৭০ সালে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে এই দিবস। তখন তিনি এর নাম দিয়েছিলেন এনভায়রনমেন্টাল টিচ-ইন। এ আন্দোলনের প্রথম সম্মেলনে প্রায় ২০ মিলিয়ন লোককে যুক্ত করেছিলেন নেলসন। এবার দিবসটির ৪০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। ২০০৯ সালে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ ধরিত্রী দিবস পালন করেছিল। কিন্তু আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ যতটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল সে অনুযায়ী তার ফল কি বিশ্ববাসী পেয়েছে?
পায়নি; বরং দিনে দিনে এ ধরিত্রীর আরো বিপর্যয় ঘটেছে। বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কার্বনের নিঃসরণ না কমে বরং বেড়েছে। এ গ্যাস নিঃসরণকারীদের তালিকায় উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি যোগ হয়েছে চীন, ভারত আর ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশ। ফলে বিপর্যয় আরো ঘনীভূত হচ্ছে। কয়েক মাস আগে হাইতিতে ভূমিকম্পে মারা গেল দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষ। তার পরপরই চিলি, ফিলিপাইন আর সবশেষ চীনে ভূমিকম্পে মারা যায় কয়েক হাজার মানুষ। বিশ্বে এখন এই যে ঘন ঘন ভূমিকম্প, খরা, অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল_এর সবই আমাদের নিজেদের ডেকে আনা। তবে এই আন্দোলনের প্রাপ্তির হিসাবটাও মন্দ নয়। এই আন্দোলনসহ পরিবেশবাদীদের অন্যান্য আন্দোলনের হাত ধরে আমরা ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকল পেয়েছিলাম। গত বছরের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন সম্মেলনে পাওয়া গেছে একটি অঙ্গীকার, যাতে আগামী শতকে বিশ্বের তাপমাত্রা কোনোভাবেই দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে তার জন্য একমত হয়েছে ১৮৯টি দেশ। চারটি দেশ স্বাক্ষর না করায় এটি বাধ্যতামূলক হতে পারেনি। সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। সেখানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি বটে; কিন্তু ক্ষতিপূরণ এখনো পাইনি। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সচেতন হতে হবে আগে। সরকার ইতিমধ্যে নিজেদের অর্থে ১০০ কোটি টাকার একটি ফান্ড করেছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়। তবে সেটা কতটা কাজে আসবে যদি জনগণ সচেতন না হয়? বাংলাদেশে গত সপ্তাহে অসময়ে কিছুটা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেল হাওরাঞ্চলের কয়েক হাজার হেক্টর জমির কাঁচা-পাকা ধান। কেন অসময়ে এমন ঢল এল তা সাধারণ কৃষক বুঝতেই পারেনি। আর সিডর-আইলার দগদগে ক্ষত এখনো উপকূলবাসীর শরীরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর সবই হচ্ছে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বরফ গলে সাগরের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে বিশ্বের বহু জনপদ। আর এই ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর শীর্ষে আছে আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু এ তাপমাত্রা বৃদ্ধি সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষ কতটা সচেতন?
আমাদের দেশে আজ পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে, বনের গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে, সমুদ্র সৈকতে হচ্ছে আবাসিক এলাকা। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহরের দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকা শহরের মানুষ হুহু করে বাড়ছে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়ি-গাড়ি। গাড়ির তালিকায় বাসের তুলনায় প্রাইভেট কারের পরিমাণ ১০ গুণের বেশি। গবেষণায় দেখা যায়, কোনো শহরে প্রাইভেট কারের পরিবর্তে যদি ট্রেন ও বাসের মতো মাচ ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করা যায়, তাহলে সেখানে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ কমানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের এ শহরে বাস-ট্রেন কমছে আর প্রাইভেট কার বাড়ছে। তাও আবার রিকন্ডিশনড, যা পরিবেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। এ অবস্থায় আমাদের এই আবাসভূমিকে বাঁচাতে আবারও জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এ ব্যাপারে যতটা সোচ্চার আমরা ঝুঁকির শীর্ষে থেকেও ততটাই নমনীয়। আমাদের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল, রাজনীতির মাঠ দখল আর সবশেষে ক্ষমতা দখলের। কিন্তু ক্ষমতায় বসতে গেলে আগে দেশকে বাঁচাতে হবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে এক দিকে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলন দরকার, তেমনি দরকার নিজের দেশের প্রত্যেক নাগরিককে এ ব্যাপারে সচেতন করে তোলা। এবারের ধরিত্রী দিবসে সেটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
No comments:
Post a Comment