Thursday, March 4, 2010

জলবায়ু পরিবর্তন ও মানসিক স্বাস্থ্য

জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ুর পরিবর্তন, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী এবং যে পরিবর্তনটি দৃশ্যমান ও পরিমাপযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর মধ্যে পরিবেশ থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র্য, খাদ্য, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প, মানববসতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিদ্যমান। এদের মধ্যে স্বাস্থ্যের অন্যতম অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ইউএনএফসিসি'র চতুর্থ রিপোর্টের (ওয়ার্কিং গ্রুপ-২) মানব স্বাস্থ্য বিষয়ক অংশের ৪২ পৃষ্ঠার মাত্র ২ থেকে ৩ পৃষ্ঠার ৩/৪ লাইন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক, যার বেশিরভাগ অংশই আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগসংলিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের দৈনন্দিন ও স্থায়ী প্রভাব যে কারণে সৃষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য ও তার সমস্যার উল্লেখ নেই বললেই চলে। এটি মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়, কারণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বরাবরই একটি অবহেলিত বিষয়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা ও মনের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে জলবায়ুর প্রভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, যা আমরা নিজের অজান্তেই অনুভব করি। সাধারণত রৌদ্রোজ্জ্বল ও সহনীয় আবহাওয়ায় আমাদের মন-মেজাজ যে রকম হাসিখুশি ও স্বতঃস্ফূর্ত থাকে ঠিক তেমনিই বাদল দিনে কিংবা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতকালে আমাদের মন-মেজাজ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। এজন্যই বোধহয় রবীন্দ্রনাথের বিরহ বেদনার গানের বড় একটি অংশজুড়ে আছে গীত বিতানের বর্ষাঋতু অংশে। আসলে সূর্যালোকের সঙ্গে আমাদের মনে গতি-প্রকৃতির পরিবর্তনের একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। সেরোটনিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যা আমাদের মস্তিষ্কের একটি স্নায়ু চক্র নিয়ন্ত্রণ করে যেটি মন-মেজাজ ও আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কার্যকলাপের দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। অনবরত অপর্যাপ্ত সূর্যালোকের প্রভাবে এই স্নায়ু চক্রটি সুস্থিরভাবে গঠিত হতে পারে না, যা পরে বিভিন্ন পারিপাশর্ি্বক মানসিক চাপজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পারঙ্গম নয়। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ব্যাহত হয়। এ বিষয়টি বিষণ্নতা ও আত্মহত্যা প্রবণতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। ইতালিতে ১৯৭৪ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ আত্মহত্যার পরিসংখ্যান থেকে এটি লক্ষ্য করা যায় যে, দুই-তৃতীয়াংশ আত্মহত্যা সংঘটিত হয় শীতকাল ও বসন্তকালে, যখন তাপমাত্রা গ্রীষ্মকাল থেকে অনেক কম থাকে। এখানে গড় তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট।
সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার নামক একটি মানসিক রোগের কথা মানসিক রোগের শ্রেণীবিন্যাসে উল্লেখ আছে। এতে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক রোগের গতি পরিবর্তনের বিষয়টির বিবরণ আছে। শীতকালে বিষণ্নতার প্রকোপ যে রকম বেশি, ঠিক সে রকম গ্রীষ্মকালে ম্যানিয়ার প্রকোপ বেশি। এসব বিষয়ের সঙ্গে দৈনন্দিন তাপমাত্রা, ঋতু পরিবর্তন, আর্দ্রতা, বায়ুর চাপ, ভৌগোলিক অবস্থান ও সূর্যালোকের উপস্থিতির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
জটিল ধরনের মানসিক রোগ যেমন সাইকোসিস, স্কিটজোফ্রিনিয়া প্রভৃতি রোগের প্রকোপের সঙ্গে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব। বৈশি্বক উষ্ণতা বৃদ্ধি এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। জাতিসংঘ জলবায়ু বিষয়ক ইউএনএফসিসি'র ৪ঃয ঝুহঃযবংরং জবঢ়ড়ৎঃ (২০০৭) অনুযায়ী বিগত ১০০ বছরে (১৯০৬-২০০৫) পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ০.৭৪০ সেঃ, যা তৃতীয় রিপোর্ট (২০০১) অনুযায়ী তাপমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি (০.৬০ সেঃ)। ফলে সমুদ্রতলের গড় উচ্চতা বৃদ্ধি ১.৮ মিঃ (১৯৬১-২০০৩) থেকে বেড়ে বর্তমানে ৩.১ মিঃ বৃদ্ধি পেয়েছে (১৯৯৩-২০০৩)। যেটি অত্যন্ত ভয়াবহ চিত্র। ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়াসহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্ব্বাস্তু হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সে সঙ্গে সিডর, আইলার মতো প্রকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে বাধ্য। ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ অপুষ্টি, বেকারত্ব ও সহায়-সম্বলহীন হওয়ার যে মানসিক যাতনা তা সরাসরি মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখবে।
গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে, বাংলাদেশসহ উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোর পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্না ভাইরাস ও হালের সোয়াইনফ্লু ভাইরাসসহ বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণ স্কিটজোফ্রিনিয়া, আবেগজনিত সমস্যা ও শুচিবায়ুসহ বিভিন্ন জটিল মানসিক রোগের ঝুঁকির অন্যতম কারণ। এছাড়াও শীতকালে ভাইরাস সংক্রমণ বিশেষভাবে গর্ভকালীন শিশুর মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতির জন্য দায়ী। এজন্য আমাদের দেশের সোয়াইনফ্লু সংক্রমণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে যদি শিশুর মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জাবেলনস্কির (১৯৯৫) গবেষণায় দেখা যায়, স্কিটজোফ্রিনিয়া রোগীদের বেশিরভাগের জন্ম শীত অথবা বসন্তকালে। এসব তথ্য-প্রমাণাদি নিঃসন্দেহে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের গভীর সম্পর্কের দিক নির্দেশ করে।
এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তীব্র জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট মানসিক সমস্যার কথায় আসি। অতি তাপমাত্রা, ঝড়োবৃষ্টি, বন্যা, খরা এবং ঝড়ঝঞ্ঝায় প্রাণহানিসহ শারীরিক আঘাত ও বিপুল পরিমাণে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ক্ষতিসাধন করে, যা পরে তীব্র ধরনের মানসিক চাপজনিত বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা তৈরি করে। এর মধ্যে অতি তাপমাত্রায় হিটস্ট্রোকের কারণে ডেলিরিয়াম (চেতনানাশসহ বিভিন্ন ধরনের মনোবৈকল্যের লক্ষণ) ও অচেতন অবস্থাসহ বিভিন্ন রকমের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় জানা যায়, ২০০৫ সালে এশিয়ায় সুনামির প্রভাবে ৩০-৫০ ভাগ জনগোাষ্ঠী মাঝারি থেকে তীব্র ধরনের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে বিষণ্নতা, মানসিক আঘাতজনিত মনোবৈকল্য, উদ্বেগ ও ভয়জনিত মানসিক সমস্যা, এবং মানিয়ে চলার সমস্যা অন্যতম। ফলে ইন্দোনেশিয়ায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, সে দেশে বহির্বিভাগে মানসিক রোগীর সংখ্যা ১৫-২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়, যা পুরো মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা। সম্প্রতি আবহাওয়া অধিদফতরের ক্লাইমেট চেঞ্জ সেল কর্তৃক জুন ২০০৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে প্রতীয়মান যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে ডায়রিয়া, চর্মরোগ, ম্যালেরিয়া, মানসিক রোগ ও ডেঙ্গু অন্যতম। এ গবেষণা রিপর্োেট দেখা যায়, বিগত ১০ বছরে (১৯৮৮-১৯৯৬) জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নতুন মানসিক রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ৪৩১ বৃদ্ধি পায়, যা ডেঙ্গুর চেয়ে বেশি (৩৩০৫)। অতএব, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে অবহেলা বা খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কর্মকৌশল প্রণয়নে স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। এ সমস্যার ব্যাপ্তি নিরূপণে প্রয়োজন দেশব্যাপী সরকারি জরিপ এখন সময়ের দাবি।
সম্প্রতি কোপেনহেগেন সম্মেলন প্রস্তুতি হিসেবে নিউইয়র্ক সম্মেলন ও ত্রিনিদাদ টোব্যাগোয় অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়শীল দেশের জন্য পৃথক তহবিল গঠনের গুরুত্বারোপ করেছেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, এই তহবিলের সময়োচিত ও যথাযোগ্য ব্যবহার। উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট অতিরিক্ত গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো ও এর ক্ষতিপূরণজনিত তহবিল গঠনে দায়দায়িত্ব এবং ভূমিকা তাদেরই বেশি হওয়া উচিত। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা ঐকমত্যে পৌছতে ব্যর্থ হলে সেটি হবে বিশ্ববাসীর জন্য একটি অশনি সংকেত। এই পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য রাখতে আমাদের সবারই একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনই আমাদের ক্ষমা করবে না।
ডা. জিলল্গুর রহমান খান (রতন) : মনোচিকিৎসক

2 comments:

  1. এই পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য রাখতে আমাদের সবারই একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কখনই আমাদের ক্ষমা করবে না। খুব ভাল লাগলো প্রতিবেদনগুলো পড়ে। আমি এই ব্লগের ব্লগারকে সাধুবাদ জানাই।

    ReplyDelete
  2. fontgulo porisker na keno?

    ReplyDelete