Saturday, April 24, 2010

লবণের গ্রাসে সিডরবিধ্বস্ত উপকূলের কৃষি: কৃষকের বুকফাটা হাহাকার

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলের নদ-নদী আর ফসলি জমিতে। লবণাক্ততার করালগ্রাসে উপকূলীয় জনপদ রূপ নিচ্ছে বিরানভূমিতে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের তথ্য মতে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে ২০ শতাংশ আবাদি জমি প্রতিবছর চাষের উপযোগিতা হারাচ্ছে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের 'সিডর' এবং ২০০৯ সালে উপকূলে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় 'আইলা' আঘাত হানে দক্ষিণ উপকূলের দরিদ্র মানুষের ওপর। ক্ষেতের ফসল, গোয়ালের গরু, আঙিনার শেষ সম্বল রেইনট্রি, কড়ই, সবজির বাগান লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এই ঝড়ে। দেশি-বিদেশি সাহায্যে আর বাঁচার অন্তহীন সংগ্রামে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এ অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। কৃষক কৃষিঋণ নিয়ে আবার মাঠে নামে। বুক বাঁধে আশায়, মুঠো মুঠো ফসল আসবে ঘরে। কিন্তু প্রকৃতি যেন বৈরী হয়ে উঠেছে এই অঞ্চলের মানুষের ওপর। কৃষকের বহু সাধনায় ফলানো রবিশস্যের মাঠে লবণ-পানি প্রবেশ করে নষ্ট হয়ে গেছে ফসল। ঘরে তো ফসল উঠছেই না উল্টো ঋণের বোঝা চেপে বসেছে কৃষকের ঘাড়ে। পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলার কৃষক আলতাফ মোল্লা (৪০) বলেন, 'কর্য কইরা ব্র্যাকের কাছ দিয়া লোন লইয়া ক্ষেতে চাষ দেছালাম, কিন্তু জোয়ারের পানিতে লবণ আইয়া মরিচ, বাঙ্গি, কলই, ডাল যা বুনাইছালাম সব পইচ্চা গেছে। ফসল তো পাইলামই না, এহন ঋণের টাহা শোধ দিমু ক্যামনে।' একই অভিযোগ উপজেলার কৃষক ফুলবানু (৪৫), রহিমা (২২), ছালেক (৬০) ও আইনুদ্দিনের (৫৫)। তাঁদের সবার মাথায় এখন ঋণের বোঝা। ব্র্যাক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে কৃষিঋণের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলের নদ-নদী আর ফসলি জমিতে। লবণাক্ততার করালগ্রাসে উপকূলীয় জনপদ রূপ নিচ্ছে বিরানভূমিতে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের তথ্য মতে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে ২০ শতাংশ আবাদি জমি প্রতিবছর চাষের উপযোগিতা হারাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে প্রায় ৮০ লাখ একর আবাদি জমি হুমকির মুখে পড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালের 'সিডর' এবং ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় 'আইলা' উপকূলীয় অঞ্চল পিরোজপুর, বরগুনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী জনপদের প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পরিমাণ ৩৬৬ কিলোমিটার। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই হাজার ১৪ কিলোমিটার। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ধীরগতি এবং কন্ট্রাক্টরদের পুকুরচুরির কারণে অসম্পন্ন বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে প্রবেশ করে জোয়ারের পানি, যার কারণে কমতে থাকে জমির উর্বরতা।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদের প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমি কম লবণাক্ত। আট লাখ হেক্টর জমি ঈষৎ লবণাক্ত। সাত লাখ হেক্টর জমি খুব বেশি লবণাক্ত। বিশেষজ্ঞরা এই লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উপকূলীয় বাঁধ উজানের প্রবাহ হ্রাস এবং অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষকে দায়ী করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কৃষিবিদ মঞ্জুর আহম্মেদ সরদার জানান, লবণ-পানির কারণে প্রতিবছর ২২০ মিলিয়ন টাকার ক্ষতি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এই লবণ-পানির কারণে শুধু চাষাবাদই ব্যাহত হচ্ছে না, খাদ্যের অভাবে গবাদিপশুর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সমস্যা।
মৃত্তিকা বিজ্ঞান ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা সূত্র জানায়, লবণাক্ততার কারণে শুধু রবিশস্য নয়, বোরো ধানও হুমকির মুখে পড়বে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের এক রিপোর্টে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। রবিশস্য হারিয়ে এই অঞ্চলের কৃষক এখন হাহাকার করছে। ধান উৎপাদনও যদি হ্রাস পায় তবে তাদের বাঁচার আর উপায় থাকবে না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবি, উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজে সরকার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিক।

No comments:

Post a Comment