Monday, April 26, 2010

কৃষিতে জলবায়ুর হিংস্র আঘাত

 বিশ্ব জলবায়ু সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রায় ৬৩ শতাংশ মানুষ গ্রাম এলাকায় বাস করে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। শতকরা ৬০ জনের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে এবং কৃষির ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিবহুল বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। জলবায়ু ঝুঁকিসূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে প্রথম, উত্তর কোরিয়ার দ্বিতীয়, নিকারাগুয়ার তৃতীয়, ওমানের চতুর্থ এবং পাকিস্তানের পঞ্চম। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলোই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম শিকার। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশে মৌসুমি ঋতু অতিমাত্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ঋতু তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে নানা ধরনের দুর্যোগ আমাদের ওপর আঘাত হানছে। বন্যা, খরা, সাইক্লোন, টর্নেডো, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি পরিবেশগত নানা সমস্যা আমাদের জীবনযাত্রাকে করছে ব্যাহত এবং আমাদের অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতিও কৃষিকে করছে বাধাগ্রস্ত। এর ফলে আমাদের দেশে যারা হতদরিদ্র ও কৃষির ওপরই সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল, তারা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সহজ শিকার এবং দারিদ্র্যের শিকারে পরিণত হচ্ছে।
অনিয়মিত দৃষ্টিপাত : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি কখন আসবে এবং কী পরিমাপ হবেÑ বর্তমানে তা আগে থেকে অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের শুরুর সময়ের কথা বলা যেতে পারে। সাধারণত মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ শুরু হয় জুলাই মাসের মধ্যবর্তী সময়ে। এর ফলে কৃষক জমি তৈরির প্রস্তুতি গ্রহণ এবং আমনের চারা রোপণ করেন। কিন্তু ওই বছর দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগস্ট মাস শুরুর আগপর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়নি। যার ফলে রোপা আমনের আবাদ দেরিতে শুরু হয়।
মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের সময় অনিয়মিত ও হঠাৎ বৃষ্টিপাত নদীর প্রবাহ হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বন্যা ও নদী দূষণের মতো ঘটনা ঘটে। কৃষিজমি পানির নিচে তলিয়ে যায় এবং বন্যা ফসলের ক্ষতি করে। ফলে নদীর তলানিতে পলিমাটি জমার পরিমাণ বেড়ে যায় এবং কোথাও কোথাও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অচল হয়ে যায়। এ জলাবদ্ধতা কৃষি ও জীবনধারণের জন্য হুমকিস্বরূপ। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় অনিয়মিত ও অত্যধিক বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জোয়ার এবং স্রোতের ফলে নদীভাঙন, নদীরক্ষা বাঁধের ভাঙন, নদী-তীরবর্তী ঘরবাড়ি ও জমির বিলুপ্তি বাড়ছে। এর ফলে ভূমিহীনতা ও উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত দীর্ঘ সময় খরার সূচনা করতে পারে, যা কৃষিতে প্রভাব ফেলবে।
খরা : খরা বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশকে নিয়মিত বিরতিতে খরার মুখোমুখি হতে হয়। বাংলাদেশের প্রায় ২.৭ মিলিয়ন হেক্টর জমি আছে, যা সহজে খরায় আক্রান্ত হয় প্রতি বছর। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশকে তার নিকট অতীতের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক খরার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ফসলের ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি খরার কারণে আবাদযোগ্য কৃষিজমির মাটি শক্ত হয়ে যায়। ফলে কৃষকের জন্য জমি চাষ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এর ফলে ছোট ও প্রান্তিক কৃষক খাদ্যের অনিশ্চয়তায় পড়ে।
বন্যা : বন্যা সাধারণত আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এর মাধ্যমে জমিতে পলিমাটি জমা হয় এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। পানিকে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলে। কিন্তু বন্যা তখনই অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়, যখন তা স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত মাত্রার লেভেল ছাড়িয়ে যায়। শস্যের ক্ষতির পাশাপাশি তখন তা মাছ চাষ ও পশুপালন বাধাগ্রস্ত করে। বাংলাদেশে প্রায় নিয়মিতই বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ১৯৮৮ সালের বন্যা (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) দেশের ৫২ জেলার ৮৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত করেছিল এবং ১ হাজার ৫১৭ জনের প্রাণহানি ঘটায়। ১৯৯৮-এর বন্যা দীর্ঘ সময় (৬৫ দিন) অবস্থান করেছিল এবং ৫৩ জেলার এক লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত করেছিল। এতে প্রাণহানি ঘটে ৯১৮ জনের। আমাদের কৃষিতে বন্যা নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে থাকেÑ ১. বাংলাদেশে খরিপ মৌসুমে ধন চাষের সময় ধানের চারা অবস্থা ও বৃদ্ধির সময় প্রায়ই তা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে ফলনও হ্রাস পায়। ২. যতো ধরনের টেকনিক্যাল বাধা আছে, আর মধ্য জলমগ্নতা ২ শতাংশ দায়ী। ৩. বাংলাদেশে প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি উচ্চমাত্রায় বন্যা একক এবং পাঁচ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি মাঝামাঝি বন্যাপ্রবণ। ৪. প্রায় ২.৬ মিলিয়ন হেক্টর, যা মোট ধানিজমির ২৪ শতাংশ; অতিরিক্ত পানির দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং দু-এক সপ্তাহ জলমগ্ন অবস্থায় থাকে (বাংলাদেশের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব পাহাড়ি নদীগুলোর অতিরিক্ত প্রবাহের কারণে যে বন্যা হয়, সাধারণত কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয়)। বন্যা যদি দীর্ঘ সময় বিদ্যমান থাকে, তাহলে তা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ১৯৯৮ সালের দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা বিদ্যমান থাকার কারণে আমন ধানের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫ শতাংশ উৎপাদন কম হয়।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা : আইপিসিসির একটি গণনা অনুমান করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০২৫, ২০৫০ এবং ২১০০ সালের মধ্যে যথাক্রমে ১৪ সেমি, ৩২ সেমি ও ৮৮ সেমি বাড়তে পারে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছেÑ সিইজিআইবির স্টাডির সত্যতা তা প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডাব্লিউডিবি) হিরণ পয়েন্টে প্রতি বছর ৫.৬ মিমি, কক্সবাজারে প্রতি বছর ১.৪ মিমি এবং খেপুপাড়ায় প্রতি বছর ২.৯ মিমি বৃদ্ধির ডাটা রেকর্ড করেছে (সিইজিআইবি, ২০০৮)। অন্যদিকে আইপিসিসির ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিশাল একটি অংশ জলমগ্ন হয়ে যাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে তা জীবনধারণের পাশাপাশি পশু পালন ও ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। হ্রাসকৃত কৃষিজমির ওপর তখন অধিকসংখ্যক জনগণ নির্ভরশীল হবে এবং এর প্রভাব পড়বে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর।
উপকূলবর্তী এলাকার মাটি ও পানি লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত হবে। এটা বেশ প্রত্যাশিত। কিন্তু এই লবণাক্ততার মাত্রা যদি আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে, তাহলে সেটা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। বিগত বছরগুলোতে নদীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে স্রোতের প্রতিকূলে লবণাক্ত পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার কারণে লবণাক্ততার পরিমাণ আরো বেড়েছে। এক মিলিয়ন হেক্টর এলাকা ইতিমধ্যে লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমার কারণে (বিশেষ করে গড়াই নদী) লবণাক্ত এলাকার পরিমাণ আরো বাড়ছে।
সাইক্লোন, টর্নেডো : সাইক্লোনের ভয়াবহতা মারাত্মক। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনে বাংলাদেশের ০.৩ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের উপকূলে যে সাইক্লোন আঘাত হানে, তার ফলে ০.১৪ মিলিয়ন লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকা দেখলে বোঝা যাবে, সাইক্লোন আমাদের দেশে বেশ নিয়মিতভাবেই আঘাত হানছে। সম্প্রতি ২০০৭ সালে সিডর এবং ২০০৯ সালে আইলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আইলার কারণে উপকূলবর্তী এলাকাগুলোর যে ক্ষতি হয়, তার ধকল সেখানকার মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে সময় সমতল ও উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে লবণাক্ত পানির যে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তা বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মৌসুমি বায়ুর পূর্ববর্তী সময়ে টর্নেডো বাংলাদেশকে আঘাত করে এবং অঞ্চলভিত্তিক ক্ষতিসাধন করে থাকে। মানুষের পাশাপাশি সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। ১৪ এপ্রিল ১৯৬৯, ১১ এপ্রিল ১৯৭৪, ১ এপ্রিল ১৯৭৭, ২৬ এপ্রিল ১৯৮৯ এবং ২০০৩ সালের টর্নেডো ছিল উল্লেখযোগ্য।

No comments:

Post a Comment