ভেঙে যায় কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। এই স্বপ্ন ভাঙার খেলায় প্রকৃতির বিরূপ আচরণ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষায় দেখা দেয় খরা, সীমিত হয়ে পড়ে পানির বিস্তার। শরৎ ও হেমন্তে ঝরে অবিরাম বৃষ্টি। বসন্তকাল পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়ে পড়ে শীতকাল। ঘন ঘন শৈত্যপ্রবাহ আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো কুয়াশাপাত এবং ঘন কুয়াশাচ্ছন্নতায় সূর্যের আলো ঢেকে রেখে যেন শৈত্য যুগের আগমনবার্তাই বহন করছে। কয়েক বছর ধরে এই শৈত্য পরিবেশে জনজীবন নাকাল হয়ে পড়াসহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ফল-ফসলের উৎপাদন। বাড়ন্ত রবিশস্যের গাছগুলো কুঁকড়ে যায়। বের হতে পারে না ফুল ও আম, লিচুর মুকুল। ব্যাহত হয়ে পড়ে শাকসবজির স্বাভাবিক ফলন। সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে বোরো ধানের বীজতলায় ও ধানের পরাগায়ণ ও প্রজনন বেলায়। বিশেষ করে যেসব এলাকায় ৫ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা ওঠানামা করে ওই সব অঞ্চলে কোল্ড ইনজুরি সমস্যাটা দেখা দেয় বেশি। ফিবছর সিলেট, মৌলভীবাজার, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জসহ অনেক এলাকায় বীজতলায় বীজ বোনার পর অঙ্কুরিত হয়নি এবং অঙ্কুরিত চারাগুলো হলদে রং ধরে মরতে শুরু করেছিল। ঠাণ্ডা কেটে যাওয়ায় শেষে রক্ষা হয়। আগে দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধানে দুই-তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস হতো। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবধান পাঁচ-দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়াতে কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি দেখা দিচ্ছে বলে কৃষিবিজ্ঞানীদের অভিমত, বীজতলায় চারা বড় হওয়ার সময় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সহনীয় হলেও এবার আড়াই সপ্তাহ গড় তাপমাত্রা ছিল ৬ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় রোদ না থাকায় বীজতলায় পানি জমে 'ডাম্পিং অফ' ও 'সিডলিং ব্লাইট' রোগে আক্রান্ত হয়ে বোনা বীজ অঙ্কুরিত হতে পারেনি এবং অঙ্কুরিত চারাগুলো হলদে রং ধরে মরে যায়। তাঁদের পরামর্শ এ পরিস্থিতিতে রাতের বেলায় বীজতলার চারাগুলো পলিথিন কাপড় বা চটের ছালা দিয়ে ঢেকে রাখলে কোল্ড ইনজুরি এড়ানো সম্ভব। এ নিয়ে অবশ্য কৃষিবিজ্ঞানীরা মাঠপর্যায়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে হয়তো আরো ভালো উপায় বেরিয়ে আসতে পারে।
কয়েক বছর আগে হাওরাঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ ও ঠাণ্ডায় কোল্ড ইনজুরিতে বোরো ধানে ব্যাপক চিটা দেখা দিয়েছিল। হাইব্রিড ধানে ৬০ থেকে ৮০ ভাগ ও ব্রি-২৮ ও ২৯ জাতের ধানে ৪০ থেকে ৬০ ভাগ চিটা পড়েছিল। স্থানীয় জাতের শাইল ও বোরো ধান কোল্ড ইনজুরিতে তেমন আক্রান্ত হয়নি। তবে ফলন কম হওয়ায় এ-জাতীয় ধান বেশি চাষাবাদ হয় না। এই স্থানীয় জাতের ধানের ঠাণ্ডা সহনীয় ক্ষমতা উফশী ও বিদেশি হাইব্রিড জাতের চেয়ে বেশি। কিন্তু কৃষকরা উচ্চ ফলনের আশায় হাইব্রিড ও উফশী ধান আবাদের দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বর্তমান আবহাওয়া ও পরিবেশে এ-জাতীয় ধান উৎপাদন ঝুঁকি ও হুমকির মধ্যে চলে এসেছে এবং কেবলই প্রকৃতিনির্ভর হয়ে পড়ছে।
২০০৬ সালে হাওরাঞ্চলে বোরো ধানে ব্যাপক চিটা দেখা দিলে কৃষিবিজ্ঞানীরা মাঠপর্যায়ে এসে এর কারণগুলো চিহ্নিত করেছিলেন। হাওর থেকে বর্ষার পানি নির্ধারিত সময়ের আগেই নেমে যাওয়ায় কৃষকরা ১৫-৩০ নভেম্বরের আগেই বীজতলায় বীজ বোনেন এবং জমিতে আগাম রোপণ করেন। এতে কাইচ থোড় আসার পর পরাগায়ণ ও প্রজনন পর্যায়ে অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হয়। সে কারণে পুংকেশর ও স্ত্রীকেশর বিকলাঙ্গ হয়ে পরাগায়ণ বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে কাইচ থোড় থেকে শুরু করে ফ্লাওয়ারিং পর্যন্ত তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি নিয়ে থাকায় এবং দিন ও রাতের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির বেশি পার্থক্য থাকায় পরাগায়ণে বাধাগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া কাইচ থোড় থেকে ফ্লাওয়ারিং পর্যন্ত তাপমাত্রা যদি ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম এবং ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়, তাহলেই ধানে চিটা দেখা দেয়। চিটা হওয়ার কারণগুলোর সারসংক্ষেপ ছিল-
(ক) নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ফসল লাগালে,
(খ) ধানগাছ প্রয়োজনীয় সময়ে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা না পেলে,
(গ) ধানের দুধ-সময়ে বা যখন দানা গঠন হয় সে সময় পোকামাকড় দ্রুত বংশবিস্তার করে ধানের দুধ চুষে খেয়ে ফেললে,
(ঘ) ধানগাছে ফুল ফোটার পর জমিতে পানির অভাব হলে,
(ঙ) ধানের ছড়া বেরোনো শুরু হওয়ার সময় বাতাসে বা অন্য কোনো কারণে গাছ হেলে পড়ে গেলে,
(চ) ফুল ফোটার সময় গরম ও শুকনো হাওয়ায় ধানের রেণু নষ্ট হয়ে গেলে,
(ছ) ফুল ফোটার পরপরই শীত বেশি পড়লে,
(জ) ধানের ছড়ায় অত্যধিক বৃষ্টি বা পানি লাগলে,
(ঝ) জমিতে অতিমাত্রায় হাইড্রোজেন সার থাকলে অথবা ফসফরাস সারের অভাব ও এর পরিমাণ অধিক হলে। এবং
(ঞ) ত্রুটিপূর্ণ বীজ হলে।
রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহারে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়া এবং ওই কারণগুলোর মধ্যে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শৈত্যপ্রবাহ ও অধিক ঠাণ্ডা কেবলই প্রকৃতির ওপর নির্ভর। এ প্রকৃতিকে মানুষই বিগড়ে দিয়েছে। এখন প্রকৃতি কোন সময় কোন আচরণ করে তা আবহাওয়াবিদদেরই বলা মুশকিল হয়ে যায়। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণে গ্রিনহাউস অ্যাফেক্টে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে ক্ষয়ধারায় ভূমণ্ডল উষ্ণ হয়ে উঠেছে। চক্রাকারে সমুদ্রের স্রোতধারা পাল্টে শীতের তাপমাত্রা সৃষ্টিতে শৈত্যপ্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারসাম্যহীন পরিবেশে প্রকৃতি করছে বিরূপ আচরণ। এ পরিস্থিতিতে আমাদের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও স্বল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টি, অতি ঠাণ্ডা ও শৈত্যপ্রবাহ প্রকৃতির বিরূপ প্রকাশ। অথবা বলা যায়, প্রকৃতির নবরূপ। এর সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে এবং তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য সংকটাপন্ন বিশ্বে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উপকূল ও প্লাবনভূমির পরিবর্তিত পরিবেশ উপযোগী করে কৃষক ও কৃষিকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। অধিক গরম ও ঠাণ্ডা বা নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রা সহনীয় এবং উপকূলে লবণাক্ততা সহনীয় জাতের ধান উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি কৃষকদের হাতে না পেঁৗছালে ওই সব অঞ্চলে ধান উৎপাদন দুরূহ হয়ে উঠবে। তাই অনেকেই মনে করেন, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে আরো শক্তিশালী করতে হবে এবং কৃষিবিজ্ঞানীদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক জাতের ধান উদ্ভাবন করে কৃষিতে নতুন করে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং প্রকৃতির অভিঘাত মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে এবং কৃষিকে প্রকৃতিসম্মত করে তুলতে হবে।
আখলাক হুসেইন খান
লেখক : সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment