বিশেষ সাক্ষাত্কার রাশেদ চৌধুরী
রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। একই সঙ্গে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাসিফিক এনসো অ্যাপলিকেশন ক্লাইমেট সেন্টারে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে কাজ করেছেন ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ক্লাইমেট প্রেডিকশনসহ (আইআরআই) বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে। জাপানের ত্সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেমে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পূর্বাভাসদানের মডেলের প্রণেতা। তাঁর জন্ম ১৯৬০ সালে। এ সাক্ষাত্কারে তিনি সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ধরন এবং আবহাওয়া ও বন্যা পূর্বাভাসব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
প্রথম আলো : গত কয়েক বছরে পর পর সিডর, বিজলি, আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় ঘন ঘন আসতে দেখছি। বৃষ্টি কম গরমও এবার বেশি। এই চরমভাবাপন্ন জলবায়ু পরিস্থিতির কারণ কী?
রাশেদ চৌধুরী : কোনো একটি বিশেষ কারণে এটা হচ্ছে না। এটা বুঝতে গেলে আগে এ অঞ্চলের জলবায়ু চক্রটা বুঝতে হবে। একে আমরা বলি এনসো চক্র। এনসো চক্রের ওপর ভিত্তি করে জলবায়ুর পূর্বাভাস বেশ কার্যকর। এনসো চক্রের তিনটি ভাগ: এল নিনো, লা নিনা; আর এ দুটি যখন প্রবল থাকে না, তাকে বলি এনসো নিউট্রাল। এল নিনো হলো শুষ্ক মৌসুম, যখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম বৃষ্টি হয় এবং বন্যাও কম হয়। আর লা নিনার সময় বেশি বৃষ্টি আর বেশি বন্যা দেখা যায়। এই এনসো চক্রের জন্ম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে একটি অঞ্চল বেশ নাজুক; বাংলাদেশের অবস্থান তার মধ্যে।
গত দু-তিন বছরের আবহাওয়ার পরিবর্তন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৬ সালের শেষ দিকে লা নিনা গঠিত হতে থাকে। লা নিনার বেলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং বেশি বন্যা হওয়ার ভয় থাকে। ২০০৭ সাল থেকে যে লা নিনা শুরু হয়, সেটাও অতটা স্বাভাবিক নয়। এটা ২০০৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বলবত্ থাকে। এটা আমাদের প্রথম নজরে আসে এপ্রিলের শুরুর দিকে। ওই সময়টা ছিল এনসো নিউট্রাল। কিন্তু নিউট্রাল অবস্থাটা হঠাত্ করেই এল নিনোর দিকে মোড় নেয়। যা কিছু ঘটছে এর জন্যই ঘটছে।
প্রথম আলো : তাহলে এটা কীভাবে আমাদের অঞ্চলকে প্রভাবিত করছে?
রাশেদ চৌধুরী : সাধারণত এল নিনো বছরগুলোতে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়; খরাজাতীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশে এ বছর কিন্তু বৃষ্টিপাত যতটা হওয়ার, ততটা হয়নি; কিছুটা খরাজাতীয় অবস্থা। এর মূল কারণ কিন্তু এল নিনো। এল নিনোর জন্য মৌসুমি বায়ু পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে যতটা বেগে আসার কথা ছিল, ততটা পারেনি। দুর্বল মৌসুমি বায়ুর কারণে বৃষ্টিপাতও কম হয়েছে। তার পরও বিভিন্ন অঞ্চলে পানি হঠাত্ যে বেড়ে গেছে, তা কিন্তু বৃষ্টির পানি না। যাকে বলে ফ্লাশ ফ্লাড বা হঠাত্ বন্যা, তা ঘটছে হিমালয়ের বরফ গলা পানির জন্য।
প্রথম আলো : এল নিনো, লা নিনার সঙ্গে কি ঝড়ঝঞ্ঝা ও বন্যার সম্পর্ক বেশি?
রাশেদ চৌধুরী : বাংলাদেশের ঝড়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি, এল নিনো বছরগুলোতে ঝড়ের মাত্রা বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে নোয়াখালী-কক্সবাজার এলাকায় বিরাট ঝড় হয়েছিল। চট্টগ্রাম সমুদ্র-উপকূলীয় অঞ্চলে নভেম্বর ১৯৭০-এর কুখ্যাত ঘূর্ণিঝড়ের কথাও সবার জানা। একইভাবে মে ১৯৮৫-তেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে উপকূলীয় অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে বড় ঝড় হয় চট্টগ্রামে। এগুলোর সবই হয়েছিল এল নিনো বছরে। নভেম্বর ২০০৭-এর প্রলয়ঙ্করী সিডরের ক্ষত তো এখনো শুকায়নি। সেটা হয়েছিল লা নিনা বছরে। আগেই বলেছি, এর শুরু ২০০৬ সাল থেকে। একইভাবে এপ্রিল ২০০৯-এ যে বিজলি হয়, সেটাও হয় লা নিনা পর্যায়ে। সম্প্রতি মে মাসে যে আইলা হয়ে গেল, তা ছিল লা নিনা আর এল নিনোর সন্ধিক্ষণে। ঝড়গুলোর বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশে বড় ঝড়গুলো হয় এল নিনো বা লা নিনা বছরে।
প্রথম আলো : এই চক্রটা কীভাবে চলে এবং ফিরে আসে?
রাশেদ চৌধুরী : এল নিনো হলে কিন্তু তার শেষ হয় লা নিনাতে। কখনো এল নিনো গঠিত হলে বুঝতে হবে এরপর লা নিনা গঠনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। সাধারণ অবস্থায় ৩ থেকে ৭ বছরে একবার এ চক্রটা ফিরে আসতে পারে। আর এলে থাকতে পারে ১ থেকে ৩ বছর। এ চক্রটা হচ্ছে কি হচ্ছে না এটা আমরা বুঝতে পারি ৯ মাস আগে থেকে। পুরো নিশ্চিত নয়, একটা ধারণা পাওয়া যায়। এল নিনোর পরিমাণ বাড়তে থাকলে বৈজ্ঞানিক মহল খুব সতর্ক হয়ে যায় যে, কিছু একটা হতে পারে।
প্রথম আলো : এর সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্কটা কী?
রাশেদ চৌধুরী : এল নিনো, লা নিনা ঘন ঘন আসার অন্যতম কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এল নিনো ও লা নিনার খতিয়ান করলে দেখা যায় যে, আগের ৩০ বছরের চেয়ে ১৯৮০ থেকে ২০০৯-এ এল নিনো, লা নিনার সংখ্যা অনেক বেশি। ১৯৯০ থেকে দেখা যাচ্ছে, আগে যদি পাঁচ বছর পর ফিরে আসত, এখন ফিরে আসার মেয়াদ দুই বছর। অর্থাত্ প্রতি এক বছর অন্তর এল নিনো, লা নিনা ফিরে আসছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এটা আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনো ও লা নিনার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
প্রথম আলো : এনসো ভিত্তিক জলবায়ু গবেষণা ও পূর্বাভাসের চিন্তা বাংলাদেশে এত বিরল কেন? এ বিষয়ে কী করতে হবে?
রাশেদ চৌধুরী : আমি যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করি। সেখানেও আবহাওয়ার সঙ্গে এল নিনো, লা নিনার সম্পর্ক বোঝে না এমন লোক অনেক। বাংলাদেশেও যদি প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের অনেকেই এটা না বোঝেন, তাতে আমি মোটেই অবাক হব না। কিন্তু অবস্থাটা এমন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটাকে বুঝতে ও মেনে নিতে হবে। এনসোভিত্তিক পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করতে হলে এ নিয়ে নতুন করে গবেষণার দরকার নেই। বিশ্বে এ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। আমরা সে রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। এ ছাড়া ওয়েবভিত্তিক অনেক তথ্যও সহজে পাওয়া যায়। দরকার হচ্ছে, এনসোর ওপর ভিত্তি করে ইমপ্যাক্ট সিনারিও অ্যাসেসমেন্ট করা; যেমন—আমি দেখালাম যে ঝড়গুলো সব সময় এল নিনো, লা নিনা বছরগুলোতেই হয়। আমাদের বড় বড় খরার বছরগুলো, বন্যার বছরগুলো কী ছিল, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
প্রথম আলো : আপনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলছেন। বিষয়টি কি ব্যাখ্যা করবেন?
রাশেদ চৌধুরী : আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত। এটা একটা নতুন চিন্তা। বিশেষ করে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এ ব্যাপারে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে এবং তারা উপকৃত হয়েছে। চীন ও ভারতেও কাজ শুরু হয়ে গেছে। এটা একাডেমিক চর্চা না, বাস্তব প্রয়োজন। এটা আগে করা কঠিন ছিল, কিন্তু এখন সম্ভব। সে ক্ষেত্রে পূর্বাভাসের লিড টাইম বাড়াতে হবে। তার জন্য স্বল্পমেয়াদি অর্থাত্ ডিটারমিনিস্টিক ফোরকাস্টের পাশাপাশি সিজনাল অর্থাত্ ছয় থেকে এক বছরের ডায়াগনস্টিক ফোরকাস্টে যেতে হবে। আমাদের এখানে আবহাওয়া পূর্বাভাস তিন থেকে সাত দিনের হয়ে থাকে। এ সময় বন্যার পানি বাড়া চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না। তিন থেকে ছয় দিনের পূর্বাভাস এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। যদি লিড টাইম তিন থেকে ছয় মাস করা যেত, তাহলে কৃষক তার বীজ বপনের পরিকল্পনা করতে পারত এবং অন্যরাও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পারত। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষিকাজ—সবই দীর্ঘমেয়াদি অর্থাত্ কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছরের পরিকল্পনার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। আগামী ছয় মাসের আবহাওয়া কেমন থাকবে, বন্যা কম না বেশি হবে তা যদি আগাম জানতে পারি তাহলে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে অপচয় ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশের আবহাওয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের মতো এনসো চক্র দ্বারা বেশি মাত্রায় প্রভাবিত। কোনোভাবে যদি আমরা এ চক্র মনিটর করতে পারি, তাহলে সহজেই তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি আগাম আভাস দিতে পারব। ঝড় সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা দেওয়া যায়। প্রাথমিক ধারণাটা কতটা শক্তিশালী হচ্ছে, তার ভিত্তিতে মাসিক পূর্বাভাসও দেওয়া সম্ভব।
প্রথম আলো : আপনারা কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলবেন কি?
রাশেদ চৌধুরী : সেখানে আমার দায়িত্ব হচ্ছে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাজুক আবহাওয়ার ছোট ছোট দ্বীপের জন্য পূর্বাভাস তৈরি করা। এই দ্বীপগুলো তো এনসো নিয়ে কাজ করে না। সেটার দরকারও নেই। তাদের দরকার হলো তাদের বাড়িঘর পানির তলায় তলিয়ে যাবে কি না, সেটা জানা। এটা অনেকটাই নির্ভর করে লা নিনা, এল নিনো হবে কি না, তার ওপর। যেমন—২০০৭-০৮ সালে আমরা সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম যে পানি এতটা বাড়বে এবং সে জন্য তাদের এতটা দূরে সরে যাওয়া দরকার। সেই পূর্বাভাস খুবই কাজে দিয়েছিল। এ ধরনের মৌলিক গবেষণা করতেই হবে।
প্রথম আলো : এর জন্য কী ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে?
রাশেদ চৌধুরী : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। হঠাত্ বললেই এ ধরনের গবেষণা গড়ে উঠবে না। এর জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যারা এনসোর ওপর ভিত্তি করে কাজ করবে, যেটা ভারতেও আছে। মূল কথা হলো, আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক কাজকে আলাদা করতে হবে। যাঁরা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, তাঁরা অনেকেই আবহাওয়ার বিষয়টিতে তত নজর দেন না, আবার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরাও জলবায়ু নিয়ে ততটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। যুক্তরাষ্ট্রেও এ নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস টিকতেই পারবে না, যদি না তা ন্যাশনাল ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট সার্ভিস হয়। অর্থাত্ আগামী দিনে আবহাওয়ার চেয়ে জলবায়ুর বিষয়টি অনেক বেশি করে ভোগাবে। আমাদের এখানে জলবায়ু নিয়ে তেমন গবেষণা হচ্ছে না। একটা জলবায়ুভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার, যেটি জলবায়ু পরির্বতনের পূর্বাভাস দেবে।
প্রথম আলো : জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক তথ্য ও ধারণাগুলো আমরা বাইরে থেকে পাই। এসব পর্যালোচনা আমাদের এখানে কতটা খাটে?
রাশেদ চৌধুরী : আইপিসিসি (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) এ নিয়ে কাজ করে। তারা সাধারণত জিসিএম অর্থাত্ গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেল বা জেনারেল সার্কুলেশন মডেল নিয়ে কাজ করে। এ মডেলগুলো করা হয় বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। অর্থাত্ ১০ বছর আগের মডেল করা হয়েছিল সে সময়ের জলবায়ুর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু সেই বর্তমান আর এই বর্তমান তো এক না। এ মডেলগুলোর ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘমেয়াদি ভিশন তৈরি করা দুরূহ ব্যাপার। প্রতিবছরই এগুলো হালনাগাদ করা দরকার। যেমন—আমি মার্শাল আইল্যান্ডস, গুয়াম, সাইপ্যান, ম্যাচরো, মাইক্রোনেশীয় দ্বীপগুলোর সমুদ্রপৃষ্ঠ নিয়ে কাজ করি। আইপিসিসির তথ্য অনুযায়ী, ওই অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কথা বছরে ১ দশমিক ৮ মিলিমিটার। তারা অবশ্য সাম্প্রতিক তথ্যের ভিত্তিতে আরেকটি পূর্বাভাসে বলেছে, এটা হবে বছরে ৩ দশমিক ১ মিলিমিটার করে। কিন্তু আমরা দেখি, এনসোর প্রভাব এতটাই প্রবল যে উচ্চতা বৃদ্ধির হিসাব কোথাও কোথাও ৫ দশমিক ৮ আবার কোথাও ৯ দশমিক ১ মিলিমিটার। বাংলাদেশের বেলায়ও নতুন তথ্য নিয়ে দেখতে হবে, আসলে কতটা কী? এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো : জলবায়ু ও আবহাওয়া বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন কতটা?
রাশেদ চৌধুরী : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুই ধরনের আঞ্চলিক ক্লাইমেট আউটলুক ফোরাম গঠন করা দরকার। সার্কের আওতার দেশগুলোকে নিয়ে হতে পারে আন্তঃদেশীয় ফোরাম। আবার বাংলাদেশের ভেতরেই সমুদ্র-উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলগুলো নিয়ে স্থানীয় ফোরাম গঠন করা যেতে পারে। এ ধরনের ফোরাম মাঝে মাঝে মিলিত হয়ে তথ্য আদান-প্রদান ও কর্মপন্থা ঠিক করতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলো নিয়ে এ রকম একটা ফোরাম আমরা গঠন করেছি। মাসিক ভিত্তিতে সেখানে মিলিত হয়ে আমরা তথ্য আদান-প্রদান করি। শুধু বিজ্ঞানীরাই নন, স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, কমিউনিটি নেতা—সবাই বসে জলবায়ুর সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতি আলোচনা করে একটা পূর্বাভাস দিই ও কর্মপন্থা ঠিক করি। অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ স্থানীয় মানুষদের মতামত নিয়ে আমাদের পূর্বাভাসও বদলাই। কারণ, স্থানীয় মানুষ অনেক বছরের অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক কিছু বুঝতে পারে। এসব সমন্বয় করে কনসেনসাস ফোরকাস্ট করি। পুরো জিনিসটাকে আমরা বলি ক্লাইমেট আউটলুক। এভাবে যে কী পরিমাণ উপকার করা যায়, তা না দেখলে ভাবা কঠিন। আমার জানা মতে, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও এ রকম আছে। জলবায়ু-বিপন্ন দেশগুলো কেউ কিন্তু বসে নেই। বাংলাদেশকেও প্রতিবেশী দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এ পথে অগ্রসর হতে হবে। উজানের দেশকে ভাটির দেশের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করে পারস্পরিক সহযোগিতার সংস্কৃতি রপ্ত করতে হবে।
প্রথম আলো : উপমহাদেশে পানি নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। এ নিয়ে কিছু বলুন।
রাশেদ চৌধুরী : আমাদের বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানির চাহিদা বেড়ে গেছে বিপুল আকারে। নদী দিয়ে যে পানি আগে আসত, তা অনেকটা আমরা খেয়েই ফেলি। কৃষিতে সেচকাজের জন্য, ব্যারাজ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়া প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশের মতো ভাটি অঞ্চলে আগের মতো পর্যাপ্ত পানি আসার সুযোগই হয় না। অন্যদিকে খরা বাড়ার কারণে এবং ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে তুলতে পাতালের পানির স্তরও অনেক নেমে গেছে। লবনাক্ত পানি মিঠা পানিকে ঢেলে ঢুকে যাচ্ছে। বন্যার পাশাপাশি খরাও হচ্ছে ঘন ঘন। কেবল বিরাট বিরাট অবকাঠামো বানিয়ে এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। পানি ব্যবস্থাপনার বেলায় ওপরের দেশ ও নিচের দেশের মধ্যে যে রকম সমঝোতা থাকা দরকার, তা না থাকায়ও সমস্যা হচ্ছে। এক দেশ আরেক দেশকে ঠিকমতো তথ্য দেয় না। অচিরেই এ অবস্থায় বদল আসা জরুরি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ চৌধুরী : ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : গত কয়েক বছরে পর পর সিডর, বিজলি, আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় ঘন ঘন আসতে দেখছি। বৃষ্টি কম গরমও এবার বেশি। এই চরমভাবাপন্ন জলবায়ু পরিস্থিতির কারণ কী?
রাশেদ চৌধুরী : কোনো একটি বিশেষ কারণে এটা হচ্ছে না। এটা বুঝতে গেলে আগে এ অঞ্চলের জলবায়ু চক্রটা বুঝতে হবে। একে আমরা বলি এনসো চক্র। এনসো চক্রের ওপর ভিত্তি করে জলবায়ুর পূর্বাভাস বেশ কার্যকর। এনসো চক্রের তিনটি ভাগ: এল নিনো, লা নিনা; আর এ দুটি যখন প্রবল থাকে না, তাকে বলি এনসো নিউট্রাল। এল নিনো হলো শুষ্ক মৌসুম, যখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম বৃষ্টি হয় এবং বন্যাও কম হয়। আর লা নিনার সময় বেশি বৃষ্টি আর বেশি বন্যা দেখা যায়। এই এনসো চক্রের জন্ম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে একটি অঞ্চল বেশ নাজুক; বাংলাদেশের অবস্থান তার মধ্যে।
গত দু-তিন বছরের আবহাওয়ার পরিবর্তন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৬ সালের শেষ দিকে লা নিনা গঠিত হতে থাকে। লা নিনার বেলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং বেশি বন্যা হওয়ার ভয় থাকে। ২০০৭ সাল থেকে যে লা নিনা শুরু হয়, সেটাও অতটা স্বাভাবিক নয়। এটা ২০০৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বলবত্ থাকে। এটা আমাদের প্রথম নজরে আসে এপ্রিলের শুরুর দিকে। ওই সময়টা ছিল এনসো নিউট্রাল। কিন্তু নিউট্রাল অবস্থাটা হঠাত্ করেই এল নিনোর দিকে মোড় নেয়। যা কিছু ঘটছে এর জন্যই ঘটছে।
প্রথম আলো : তাহলে এটা কীভাবে আমাদের অঞ্চলকে প্রভাবিত করছে?
রাশেদ চৌধুরী : সাধারণত এল নিনো বছরগুলোতে বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়; খরাজাতীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশে এ বছর কিন্তু বৃষ্টিপাত যতটা হওয়ার, ততটা হয়নি; কিছুটা খরাজাতীয় অবস্থা। এর মূল কারণ কিন্তু এল নিনো। এল নিনোর জন্য মৌসুমি বায়ু পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে যতটা বেগে আসার কথা ছিল, ততটা পারেনি। দুর্বল মৌসুমি বায়ুর কারণে বৃষ্টিপাতও কম হয়েছে। তার পরও বিভিন্ন অঞ্চলে পানি হঠাত্ যে বেড়ে গেছে, তা কিন্তু বৃষ্টির পানি না। যাকে বলে ফ্লাশ ফ্লাড বা হঠাত্ বন্যা, তা ঘটছে হিমালয়ের বরফ গলা পানির জন্য।
প্রথম আলো : এল নিনো, লা নিনার সঙ্গে কি ঝড়ঝঞ্ঝা ও বন্যার সম্পর্ক বেশি?
রাশেদ চৌধুরী : বাংলাদেশের ঝড়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি, এল নিনো বছরগুলোতে ঝড়ের মাত্রা বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালের মে মাসে নোয়াখালী-কক্সবাজার এলাকায় বিরাট ঝড় হয়েছিল। চট্টগ্রাম সমুদ্র-উপকূলীয় অঞ্চলে নভেম্বর ১৯৭০-এর কুখ্যাত ঘূর্ণিঝড়ের কথাও সবার জানা। একইভাবে মে ১৯৮৫-তেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে উপকূলীয় অঞ্চলে বড় ঝড় হয়। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে বড় ঝড় হয় চট্টগ্রামে। এগুলোর সবই হয়েছিল এল নিনো বছরে। নভেম্বর ২০০৭-এর প্রলয়ঙ্করী সিডরের ক্ষত তো এখনো শুকায়নি। সেটা হয়েছিল লা নিনা বছরে। আগেই বলেছি, এর শুরু ২০০৬ সাল থেকে। একইভাবে এপ্রিল ২০০৯-এ যে বিজলি হয়, সেটাও হয় লা নিনা পর্যায়ে। সম্প্রতি মে মাসে যে আইলা হয়ে গেল, তা ছিল লা নিনা আর এল নিনোর সন্ধিক্ষণে। ঝড়গুলোর বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশে বড় ঝড়গুলো হয় এল নিনো বা লা নিনা বছরে।
প্রথম আলো : এই চক্রটা কীভাবে চলে এবং ফিরে আসে?
রাশেদ চৌধুরী : এল নিনো হলে কিন্তু তার শেষ হয় লা নিনাতে। কখনো এল নিনো গঠিত হলে বুঝতে হবে এরপর লা নিনা গঠনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। সাধারণ অবস্থায় ৩ থেকে ৭ বছরে একবার এ চক্রটা ফিরে আসতে পারে। আর এলে থাকতে পারে ১ থেকে ৩ বছর। এ চক্রটা হচ্ছে কি হচ্ছে না এটা আমরা বুঝতে পারি ৯ মাস আগে থেকে। পুরো নিশ্চিত নয়, একটা ধারণা পাওয়া যায়। এল নিনোর পরিমাণ বাড়তে থাকলে বৈজ্ঞানিক মহল খুব সতর্ক হয়ে যায় যে, কিছু একটা হতে পারে।
প্রথম আলো : এর সঙ্গে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্কটা কী?
রাশেদ চৌধুরী : এল নিনো, লা নিনা ঘন ঘন আসার অন্যতম কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এল নিনো ও লা নিনার খতিয়ান করলে দেখা যায় যে, আগের ৩০ বছরের চেয়ে ১৯৮০ থেকে ২০০৯-এ এল নিনো, লা নিনার সংখ্যা অনেক বেশি। ১৯৯০ থেকে দেখা যাচ্ছে, আগে যদি পাঁচ বছর পর ফিরে আসত, এখন ফিরে আসার মেয়াদ দুই বছর। অর্থাত্ প্রতি এক বছর অন্তর এল নিনো, লা নিনা ফিরে আসছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এটা আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনো ও লা নিনার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
প্রথম আলো : এনসো ভিত্তিক জলবায়ু গবেষণা ও পূর্বাভাসের চিন্তা বাংলাদেশে এত বিরল কেন? এ বিষয়ে কী করতে হবে?
রাশেদ চৌধুরী : আমি যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করি। সেখানেও আবহাওয়ার সঙ্গে এল নিনো, লা নিনার সম্পর্ক বোঝে না এমন লোক অনেক। বাংলাদেশেও যদি প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের অনেকেই এটা না বোঝেন, তাতে আমি মোটেই অবাক হব না। কিন্তু অবস্থাটা এমন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটাকে বুঝতে ও মেনে নিতে হবে। এনসোভিত্তিক পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করতে হলে এ নিয়ে নতুন করে গবেষণার দরকার নেই। বিশ্বে এ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। আমরা সে রকম কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। এ ছাড়া ওয়েবভিত্তিক অনেক তথ্যও সহজে পাওয়া যায়। দরকার হচ্ছে, এনসোর ওপর ভিত্তি করে ইমপ্যাক্ট সিনারিও অ্যাসেসমেন্ট করা; যেমন—আমি দেখালাম যে ঝড়গুলো সব সময় এল নিনো, লা নিনা বছরগুলোতেই হয়। আমাদের বড় বড় খরার বছরগুলো, বন্যার বছরগুলো কী ছিল, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
প্রথম আলো : আপনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলছেন। বিষয়টি কি ব্যাখ্যা করবেন?
রাশেদ চৌধুরী : আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত। এটা একটা নতুন চিন্তা। বিশেষ করে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এ ব্যাপারে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে এবং তারা উপকৃত হয়েছে। চীন ও ভারতেও কাজ শুরু হয়ে গেছে। এটা একাডেমিক চর্চা না, বাস্তব প্রয়োজন। এটা আগে করা কঠিন ছিল, কিন্তু এখন সম্ভব। সে ক্ষেত্রে পূর্বাভাসের লিড টাইম বাড়াতে হবে। তার জন্য স্বল্পমেয়াদি অর্থাত্ ডিটারমিনিস্টিক ফোরকাস্টের পাশাপাশি সিজনাল অর্থাত্ ছয় থেকে এক বছরের ডায়াগনস্টিক ফোরকাস্টে যেতে হবে। আমাদের এখানে আবহাওয়া পূর্বাভাস তিন থেকে সাত দিনের হয়ে থাকে। এ সময় বন্যার পানি বাড়া চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না। তিন থেকে ছয় দিনের পূর্বাভাস এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না। যদি লিড টাইম তিন থেকে ছয় মাস করা যেত, তাহলে কৃষক তার বীজ বপনের পরিকল্পনা করতে পারত এবং অন্যরাও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পারত। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষিকাজ—সবই দীর্ঘমেয়াদি অর্থাত্ কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছরের পরিকল্পনার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। আগামী ছয় মাসের আবহাওয়া কেমন থাকবে, বন্যা কম না বেশি হবে তা যদি আগাম জানতে পারি তাহলে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে অপচয় ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশের আবহাওয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলের মতো এনসো চক্র দ্বারা বেশি মাত্রায় প্রভাবিত। কোনোভাবে যদি আমরা এ চক্র মনিটর করতে পারি, তাহলে সহজেই তিন থেকে ছয় মাস মেয়াদি আগাম আভাস দিতে পারব। ঝড় সম্পর্কেও প্রাথমিক ধারণা দেওয়া যায়। প্রাথমিক ধারণাটা কতটা শক্তিশালী হচ্ছে, তার ভিত্তিতে মাসিক পূর্বাভাসও দেওয়া সম্ভব।
প্রথম আলো : আপনারা কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলবেন কি?
রাশেদ চৌধুরী : সেখানে আমার দায়িত্ব হচ্ছে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাজুক আবহাওয়ার ছোট ছোট দ্বীপের জন্য পূর্বাভাস তৈরি করা। এই দ্বীপগুলো তো এনসো নিয়ে কাজ করে না। সেটার দরকারও নেই। তাদের দরকার হলো তাদের বাড়িঘর পানির তলায় তলিয়ে যাবে কি না, সেটা জানা। এটা অনেকটাই নির্ভর করে লা নিনা, এল নিনো হবে কি না, তার ওপর। যেমন—২০০৭-০৮ সালে আমরা সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম যে পানি এতটা বাড়বে এবং সে জন্য তাদের এতটা দূরে সরে যাওয়া দরকার। সেই পূর্বাভাস খুবই কাজে দিয়েছিল। এ ধরনের মৌলিক গবেষণা করতেই হবে।
প্রথম আলো : এর জন্য কী ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে?
রাশেদ চৌধুরী : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। হঠাত্ বললেই এ ধরনের গবেষণা গড়ে উঠবে না। এর জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যারা এনসোর ওপর ভিত্তি করে কাজ করবে, যেটা ভারতেও আছে। মূল কথা হলো, আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক কাজকে আলাদা করতে হবে। যাঁরা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, তাঁরা অনেকেই আবহাওয়ার বিষয়টিতে তত নজর দেন না, আবার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরাও জলবায়ু নিয়ে ততটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। যুক্তরাষ্ট্রেও এ নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস টিকতেই পারবে না, যদি না তা ন্যাশনাল ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট সার্ভিস হয়। অর্থাত্ আগামী দিনে আবহাওয়ার চেয়ে জলবায়ুর বিষয়টি অনেক বেশি করে ভোগাবে। আমাদের এখানে জলবায়ু নিয়ে তেমন গবেষণা হচ্ছে না। একটা জলবায়ুভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার, যেটি জলবায়ু পরির্বতনের পূর্বাভাস দেবে।
প্রথম আলো : জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক তথ্য ও ধারণাগুলো আমরা বাইরে থেকে পাই। এসব পর্যালোচনা আমাদের এখানে কতটা খাটে?
রাশেদ চৌধুরী : আইপিসিসি (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) এ নিয়ে কাজ করে। তারা সাধারণত জিসিএম অর্থাত্ গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেল বা জেনারেল সার্কুলেশন মডেল নিয়ে কাজ করে। এ মডেলগুলো করা হয় বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। অর্থাত্ ১০ বছর আগের মডেল করা হয়েছিল সে সময়ের জলবায়ুর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু সেই বর্তমান আর এই বর্তমান তো এক না। এ মডেলগুলোর ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘমেয়াদি ভিশন তৈরি করা দুরূহ ব্যাপার। প্রতিবছরই এগুলো হালনাগাদ করা দরকার। যেমন—আমি মার্শাল আইল্যান্ডস, গুয়াম, সাইপ্যান, ম্যাচরো, মাইক্রোনেশীয় দ্বীপগুলোর সমুদ্রপৃষ্ঠ নিয়ে কাজ করি। আইপিসিসির তথ্য অনুযায়ী, ওই অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কথা বছরে ১ দশমিক ৮ মিলিমিটার। তারা অবশ্য সাম্প্রতিক তথ্যের ভিত্তিতে আরেকটি পূর্বাভাসে বলেছে, এটা হবে বছরে ৩ দশমিক ১ মিলিমিটার করে। কিন্তু আমরা দেখি, এনসোর প্রভাব এতটাই প্রবল যে উচ্চতা বৃদ্ধির হিসাব কোথাও কোথাও ৫ দশমিক ৮ আবার কোথাও ৯ দশমিক ১ মিলিমিটার। বাংলাদেশের বেলায়ও নতুন তথ্য নিয়ে দেখতে হবে, আসলে কতটা কী? এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো : জলবায়ু ও আবহাওয়া বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন কতটা?
রাশেদ চৌধুরী : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দুই ধরনের আঞ্চলিক ক্লাইমেট আউটলুক ফোরাম গঠন করা দরকার। সার্কের আওতার দেশগুলোকে নিয়ে হতে পারে আন্তঃদেশীয় ফোরাম। আবার বাংলাদেশের ভেতরেই সমুদ্র-উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলগুলো নিয়ে স্থানীয় ফোরাম গঠন করা যেতে পারে। এ ধরনের ফোরাম মাঝে মাঝে মিলিত হয়ে তথ্য আদান-প্রদান ও কর্মপন্থা ঠিক করতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলো নিয়ে এ রকম একটা ফোরাম আমরা গঠন করেছি। মাসিক ভিত্তিতে সেখানে মিলিত হয়ে আমরা তথ্য আদান-প্রদান করি। শুধু বিজ্ঞানীরাই নন, স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, কমিউনিটি নেতা—সবাই বসে জলবায়ুর সম্ভাব্য গতি-প্রকৃতি আলোচনা করে একটা পূর্বাভাস দিই ও কর্মপন্থা ঠিক করি। অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ স্থানীয় মানুষদের মতামত নিয়ে আমাদের পূর্বাভাসও বদলাই। কারণ, স্থানীয় মানুষ অনেক বছরের অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক কিছু বুঝতে পারে। এসব সমন্বয় করে কনসেনসাস ফোরকাস্ট করি। পুরো জিনিসটাকে আমরা বলি ক্লাইমেট আউটলুক। এভাবে যে কী পরিমাণ উপকার করা যায়, তা না দেখলে ভাবা কঠিন। আমার জানা মতে, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও এ রকম আছে। জলবায়ু-বিপন্ন দেশগুলো কেউ কিন্তু বসে নেই। বাংলাদেশকেও প্রতিবেশী দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এ পথে অগ্রসর হতে হবে। উজানের দেশকে ভাটির দেশের সঙ্গে তথ্য ভাগাভাগি করে পারস্পরিক সহযোগিতার সংস্কৃতি রপ্ত করতে হবে।
প্রথম আলো : উপমহাদেশে পানি নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। এ নিয়ে কিছু বলুন।
রাশেদ চৌধুরী : আমাদের বৃহত্তর গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানির চাহিদা বেড়ে গেছে বিপুল আকারে। নদী দিয়ে যে পানি আগে আসত, তা অনেকটা আমরা খেয়েই ফেলি। কৃষিতে সেচকাজের জন্য, ব্যারাজ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়া প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশের মতো ভাটি অঞ্চলে আগের মতো পর্যাপ্ত পানি আসার সুযোগই হয় না। অন্যদিকে খরা বাড়ার কারণে এবং ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে তুলতে পাতালের পানির স্তরও অনেক নেমে গেছে। লবনাক্ত পানি মিঠা পানিকে ঢেলে ঢুকে যাচ্ছে। বন্যার পাশাপাশি খরাও হচ্ছে ঘন ঘন। কেবল বিরাট বিরাট অবকাঠামো বানিয়ে এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। পানি ব্যবস্থাপনার বেলায় ওপরের দেশ ও নিচের দেশের মধ্যে যে রকম সমঝোতা থাকা দরকার, তা না থাকায়ও সমস্যা হচ্ছে। এক দেশ আরেক দেশকে ঠিকমতো তথ্য দেয় না। অচিরেই এ অবস্থায় বদল আসা জরুরি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ চৌধুরী : ধন্যবাদ।
< সাক্ষাৎকারটি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় 09-08-2009 তারিখে ছাপা হয়েছে >
No comments:
Post a Comment