জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে আপনাদের নানা প্রশ্নের জবাব রয়েছে এখানে:
পৃথিবীর অধিকাংশ সরকারই মনে করে জলবায়ু পরিবর্তন মানব সমাজ এবং স্বাভাবিক পৃথিবীর জন্য হুমকি।
ধারাবাহিক বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনগুলো- বিশেষ করে যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) কর্তৃক প্রণীত - এমন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে সেখানে বলা হচ্ছে, মানুষের কর্মকান্ড আধুনিককালের জলবায়ু এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব রাখে।
দু‘বছর আগে, বালিতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক আলোচনায় সরকারগুলো একটা বিশ্বব্যাপী নতুন ঐকমত্যের উপর কাজ শুরু করতে সম্মত হয়।
কোপেনহেগেন আলোচনা দুই বছরের মধ্যে শেষ হবে।
সরকারগুলো আশা করছে ডেনমার্কের রাজধানী ত্যাগ করবার আগেই একটা নতুন সমঝোতায় পৌঁছানো যাবে।
আলোচনাগুলো কৌশলগতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের সদস্যগুলোর কর্মপরিধি সম্মেলনের ১৫তম আলোচনাসভা নামে পরিচিত। প্রায়শঃই যাকে সংক্ষেপে কপ১৫ (COP15) বলা হয়।
প্র: জলবায়ু পরিবর্তন কেন হচ্ছে এবং এটা কি বৈশ্বিক উষ্ণতার মত একই রকম কোন ঘটনা?
সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে৻ যেমন, আমাদের পৃথিবীর কক্ষপথে কোন পরিবর্তন ঘটলে সূর্য থেকে এর দূরত্বেও পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে উষ্ণতর জলবায়ূর মধ্যে বরফ যুগের সূচনা হয়।
সর্বশেষ আইপিসিসি প্রতিবেদন অনুযায়ী আধুনিককালে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানভাবে মানবজাতির দায়ী হওয়ার সম্ভাবনা ৯০% এর বেশী।
এর পেছনে প্রধাণ কারণ জীবাশ্ব জ্বালানী ( কয়লা, তেল, গ্যাস ) পোড়ানো।
এতে কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয় এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে যুক্ত হয়। যা একটা কম্বলের মত কাজ করে; সৌরশক্তি এর নিচে আটকা পড়ে এবং ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়।
বন উজাড় হওয়ার কারনে এবং অন্যান্য গ্রীনহাউস গ্যাস যেমন মিথেন নির্গমণকারী প্রক্রিয়াগুলো এতে অবদান রাখে।
এর প্রাথমিক প্রভাব গোটা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে (বৈশ্বিক উষ্ণায়ন) হলেও এটা বৃষ্টিপাতের রীতিতে পরিবর্তন, সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, দিন ও রাতের তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য তৈরীর মত ঘটনা ঘটায়।
এই জটিলতর বিশৃঙ্খলাই জলবায়ু পরিবর্তন নামে চিহ্নিত। আরো সঠিকভাবে বললে, 'মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন'।
প্র: একটা নতুন চুক্তি কেন দরকার পড়লো?
কোপেনহেগেন আলোচনা হয় ইউএনএফসিসিসি`র কাঠামোর মধ্যে। এটি ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত আর্থ সামিটের সময় গঠিত হয়।
১৯৯৭ সালে ইউএনএফসিসিসি জন্ম দেয় কিয়োটো প্রোটকল।
কিন্তু ঐকমত্যগুলির কোনটিই আইপিসিসি কর্তৃক প্রাক্কলিত মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এড়াতে, ক্রমবর্ধমান গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমণ যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়নি।
বিশেষতঃ কিয়োটো প্রোটকলের নির্গমণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অল্প কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং এর মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হয়ে যাবে।
সরকারগুলো একটা নতুন চুক্তি চাইছে যা কিয়োটো ঐকমত্যের চাইতেও বিস্তৃত, সুদৃঢ়, ব্যাপক-ভিত্তিক এবং তুলনামূলকভাবে আধুনিক।
জুন মাসে, জি-৮ এবং কতগুলো উন্নয়নশীল দেশ প্রাক-শিল্পায়নের সময় থেকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সে. (৩.৬ ডিগ্রী ফা.) এর মধ্যে সীমিত রাখার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
নীতিগতভাবে এসব দেশ কোপেনহেগেন চুক্তির মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমান গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ করতে আগ্রহী যার ফলে পৃথিবীর বর্ধিত তাপমাত্রা ঐ ২ ডিগ্রী সে. এর মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে৻
প্র: নতুন চুক্তিটি থেকে কে কী প্রত্যাশা করছে?
এখানে অনেকগুলো ইস্যু জড়িত; জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করবে।
এইসব অঙ্গীকার পূরণের সময়সীমা ২০২০ সাল। যদিও কেউ কেউ এই সময়সীমা ২০৫০ সালেরও পরে আশা করছে।
অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং নিউজিল্যান্ড ইতোমধ্যেই বলছে, তারা ২০২০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পুরণ করতে প্রস্তুত রয়েছে।
অপেক্ষাকৃত ধনী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য করা হতে পারে।
যদি তারা কোন প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে গ্রীনহাউস গ্যাস কমানোর চাইতে তারা নির্গমনের হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে আগ্রহী হবে৻
তাদের প্রতিশ্রুতিগুলি অনেকটা এরকম, 'সবকিছু স্বাভাবিক রেখে' তারা ক্রমবর্ধনশীল নির্গমণের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করবে।
গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমণ কমাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করতে চায় শিল্পোন্নত দেশগুলো। এব্যাপারে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানীর মত খাতে সহযোগিতা দিতে নীতিগতভাবে সম্মত আছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো এই প্রযুক্তি হস্তান্তর গতিশীল করতে কার্যকর কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে চাচ্ছে।
বেশ কিছু দেশ ভাবছে, কি ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া যায়, এতে কি ধরণের অভিযোজন প্রয়োজন হবে ইত্যাদি।
এগুলোর মধ্যে সমূদ্রের জল থেকে রক্ষা, মিঠা পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা, নতুন নতুন ফসলের জাত তৈরীর মত বিষয়গুলিও অন্তর্ভুক্ত।
উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদেরকে অভিযোজনে সহযোগীতা করতে পর্যাপ্ত এবং নির্ভরযোগ্য অর্থসংস্থান প্রত্যাশা করছে।
তাদের যুক্তি হলো, যেহেতু শিল্পন্নত বিশ্ব সমস্যাটা তৈরী করেছে তাই এর সমাধানও তাদেরই করতে হবে। বন সংরক্ষণও এই সমঝোতার একটা দিক।
প্র: এর পেছনে কত ব্যয় হবে?
সাধারণভাবে, জীবাশ্ব জ্বালানী হল সব থেকে সস্তা শক্তির উৎস। গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমণ নিয়ন্ত্রণের প্রধান পথ হল জীবাশ্ব জ্বালানী পোড়ানো বাদ দেয়া। ফলে এ ধরণের একটা সফল চুক্তি প্রায় নিশ্চিতভাবেই জ্বালানী শক্তিকে ব্যয়বহুল করে তুলবে।
জলবায়ু পরিবর্তন এড়াতে এই রূপান্তর দ্রুত সম্পাদনের জন্য সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পরিমাণ বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো এ বাবদ শতশত বিলিয়ন ডলার প্রত্যাশা করছে।
কতগুলো গবেষণায় অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার বা তার কাছাকাছি পরিমাণের অর্থ সাহায্য প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
তুলনামূলকভাবে বর্তমানে ধনী দেশগুলো কর্তৃক পাঠানো বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার।
প্র: এ ধরনের একটা সমঝোতার জন্য সম্ভাবনাগুলো কি কি?
কোপেনহেগেন শীর্ষসম্মেলন থেকে চারটি বড় ঘটনা ঘটতে পারে:
সেগুলো হচ্ছে:
- শিথিল দিকগুলোকে সম্পৃক্ত করে একটা সমন্বিত সমঝোতা৻
- বড় লক্ষ্যে সম্মত হয়ে একটা চুক্তি, যার প্রচুর খুটিনাটি বিষয়াদি পরবর্তি মাস বা বছরগুলোতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিস্পত্তি করা৻
- কপ (সিওপি) এর কার্যক্রম সম্ভবত ২০১০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূলতবিকরণ৻
- সম্মেলনটি বিফল হওয়া৻
যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যগুলো কিয়োটো প্রোটকলের লক্ষ্যমাত্রার মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হয়ে যাবার ব্যাপারে সচেতন, তাই প্রায় প্রত্যেকটি সরকার আলোচনায় উপস্থিত থাকছে এবং দ্রুত একটা সমঝোতায় পৌঁছুতে চাচ্ছে।
কিন্তু খুঁটিনাটি অনেক কাজ সম্পন্ন করা বাকি রয়ে গেছে। এবং যেহেতু যে কোন চুক্তি ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়, তাই সেখানে প্রচুর মতভিন্নতার ক্ষেত্রও থাকে এবং যে কোন একটি দেশই গোটা আলোচনা পন্ড করে দিতে পারে।
প্র: কোপেনহেগেন সমঝোতা কি জলবায়ু সমস্যার সমাধান দিতে পারবে?
বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ইতোমধ্যেই প্রাক-শিল্পায়নের সময়কাল থেকে ০.৭ ডিগ্রী সে. বেড়ে গেছে।
ইতোমধ্যে পৃথিবীর কোন কোন অংশে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে দিয়েছে। এবং কোপেনহেগেনে কোন একটা সমঝোতা তা থামাতে পারত না, যদিও অর্থ সরবরাহ করে কিছু পরিণতির সাথে আপোষ-রফা করতে পারত।
গ্রীন হাউস গ্যাস, যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, দশকের পর দশক ধরে বায়ুমন্ডলে থেকে যায়। আর এর ঘনমাত্রা ইতোমধ্যেই যথেষ্ট বেড়ে গেছে। ফলে অধিকতর উষ্ণয়ন অবশ্যম্ভাবী।
অনেক বিশ্লেষণে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে যে, প্রাক-শিল্পায়নকাল থেকে এ পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা গড়ে ১.৫ ডিগ্রী সে. বৃদ্ধি পেয়েছে।
কোপেনহেগেনে একটা শক্তিশালী সমঝোতা তাপমাত্রার বৃদ্ধি হয়ত ২ ডিগ্রী সে. এর নিচে রাখতে পারবে। কিন্তু তাপমাত্রার এই বৃদ্ধিতে বায়ুমন্ডল ও সমূদ্রগুলো কিরূপ আচরণ করবে তার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।
এ কারণেই উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোজনের উপর এত গুরুত্ব আরোপ করছে। ইতোমধ্যেই তাদের যুক্তিগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আইপিসিসিসি পরামর্শ দিয়ে বলেছে, ২ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রা বৃদ্ধি এড়ানোর সম্ভাবনা থাকবে যদি বর্তমান মাত্রাকে সর্বোচ্চ ধরে নেয়া হয় এবং এখন থেকে ১৫-২০ বছরের মধ্যে তাকে নিম্নমূখী করা হয়।
সম্প্রতি শিল্পোন্ত দেশগুলো গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমণ হ্রাসের ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা সামগ্রীকভাবে বর্ধনশীল বৈশ্বিক নির্গমণ থামাতে যথেষ্ট নয়।
কোপেনহেগেনে যাই ঘটুক, নতুন চুক্তির ধারাসমূহ চূড়ান্ত করতে নিশ্চিতভাবেই আরও আলোচনার প্রয়োজন হবে।
ভবিষ্যতে এটুকু বলা যায়, চুক্তিটি নিরাপদ করতে কিছু বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই সরকারগুলো কোপেনহেগেন সম্মেলনের পর থেকেই সক্রিয় হবে।
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা
No comments:
Post a Comment