Saturday, February 13, 2010

হুমকির মুখে সুন্দরবন, দিশেহারা মানুষ

the sundarbans


অতি লবণাক্ততায় মরে যাচ্ছে উপকূলীয় বাদাবন৻
নদী-খাল-জমিতে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততায় বিপর্যস্ত হচ্ছে সুন্দরববনের জীব বৈচিত্র এবং প্রাকৃতিক সম্পদ৷ সেই সাথে দিশেহারা হয়ে পড়ছে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষজন৷
মংলার অদূরে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শুরু৷ করমজল খাল ধরে ইঞ্জিনের নৌকোয় যেতে যেতে ডেপুটি রেঞ্জার আব্দুর রব দেখাচ্ছিলেন সম্ভবত যে গাছের নামে এই জঙ্গলের নাম, সেই সুন্দরী কিভাবে বিলীন হচ্ছে৷
“আনুমানিক চল্লিশ বছর আগে বিলীন হবার এই প্রবণতা দেখা গেছে, তবে তখন তা ছিল খুবই কম৻ কিন্তু এখন ব্যপকভাবে বেড়ে গেছে৻ সুন্দরী গাছের সবগুলোই প্রায় কালো হয়ে মরে যাচ্ছে৻ এখন এগুলোর আর কোনই মূল্য নেই৻`` মি. রব বললেন, ‘‘সুন্দরবনের তিনশো চৌত্রিশটি উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে সুন্দরীই প্রধানতম৻ এখানকার তেয়াত্তর ভাগ জায়গা এই গাছ একাই দখল করে আছে৻ আগামী পঞ্চাশ বছর পরে সুন্দরবনের তেয়াত্তর ভাগ জায়গা এমনিভাবেই উজাড় হয়ে যাবে৻``
সুন্দরীর মত স্বল্প-লবণ-সহিষ্ণু প্রজাতিগুলোর অস্তিত্বের এই সঙ্কটের কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনের নদী এবং খালগুলিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন৷
sundari tree
মরে যাচ্ছে সুন্দরী গাছের ডগা
তবে এর জন্য অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ যতটা না সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াকে সন্দেহ করছেন, তার চেয়ে বেশী দায়ী করছেন গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধকে৷
নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলছেন, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা এই অঞ্চলগুলোতে প্রথমে লবণাক্ততা বেড়েছিল ফারাক্কা বাঁধের পর থেকে৻ কিন্তু এখন সবাই এটা ভুলে গেছেন৻
তিনি বলছেন, যেহেতু উজানের মিঠা পানির সাথে এদের একেবারেই কোন সম্পর্ক নেই, বর্ষার সময় জলাঙ্গী মাথাভাঙ্গা পদ্ধতিতে সামান্য কিছু মিঠা পানি আসে, সেহেতু ১৯৭৫ সালের পর থেকে লবণাক্ততা এমনিতেই তীব্রভাবে বেড়ে গেছে৻
এই সমস্যা সমুদ্রপানির উচ্চতা বাড়ার কারণে আরো জটিল হয়েছে বলে তিনি জানালেন৻
মঙ্গলার কাছে চিলায় পশুর নদী থেকে বেরিয়ে আসা খালটিতে সারি দেয়া সব জেলে নৌকো৷ মাছ ধরতে বেরুনোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন জেলেরা৷
কোন কোন নৌকোর ভেতরে খাঁচায় আটকানো উদ্বিড়াল বা ভোঁদড়, যার ইংরিজি নাম অটার৷ উদ্বিড়াল দেখতে অনেকটা বড় আকারের বেজির মত৻
একজন জেলে জানান কিভাবে এই ভোঁদড় ব্যবহার করে তারা মাছ ধরেন: উদ্বিড়ালগুলোকে রশি দিয়ে বেঁধে জলে ছেড়ে দেয়ার পর এগুলো মাছ তাড়িয়ে নিয়ে আসে৻ বাজার থেকে প্রশিক্ষন পাওয়া এসব ভোঁদড় কিনতে হয়৻ একেকটার দাম দশ থেকে বারো হাজার টাকা৻
আরেকজন জেলে বললেন ১০ বা ১৫ বছর আগে সুন্দরবনের নদীগুলোতে যে পরিমান মাছ পাওয়া যেত, এখন তার সিকি ভাগও নেই৻ নদী শুকিয়ে যাবার কারণে আর অসময়ে বন্যা হবার কারনেও মাছ কমে যাচ্ছে৻
fishing community
বনের সাথে কমে যাচ্ছে নদীর মাছ৻
তিনি জানান ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন বন্যা হতো বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে, আর এখন হয় অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে৻
জল সংকটে পশুর নদী, মংলায় রামপাল, ভোলার চম্পাই নদী শুকিয়ে গেছে৻ বিভিন্ন জায়গায় ঘের দেবার কারণে নদীতে পানি ঢুকতে পারছে না৻ লোকজন সেখানে ঘর-বাড়ী তৈরী করছে৻
সুন্দরবনের ভূ প্রকৃতিতে, জীববৈচিত্রে, সম্পদে নেতিবাচক যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তার দায়ভাগ কতটা জলবায়ু পরিবর্তন আর কতটা মানুষের তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে৷
সুন্দরী গাছ বিলীন হলেও, অভিযোজনের নিয়মে অন্য লবণসহিষ্ণু গাছ সে জায়গা নিয়ে নেবে -- এরকম আশাবাদের কথাও শোনালেন বনরক্ষক মিজানুর রহমান৷
তবে লবণে, নদী ভরাটে আর অসময়ে ঝড়-বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন সুন্দরবনের জেলে এবং বাওয়ালীরা৷ বনের ওপর নির্ভর করে জীবিকা কতদিন চলবে, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে৻
সুন্দরবনের একজন বাওয়ালী বলছিলেন, “গত আইলা ঝড়ের পরে সুন্দরবনের প্রচন্ড ক্ষতি হয়েছে৻ সুন্দরবন একেবারে নীচু হয়ে গেছে৻ আগে যেখানে পানি উঠতো না এখন সেসব জায়গা দুই তিন হাত নীচু হয়ে গেছে৻
‘‘বিশ বছর আগে যেখানে পানি উঠতে দেখিনি, এখন জোয়াড়ের সময় সেখানে পানি উঠে যায়৻ আগে বছরে মিঠা পানি পেতাম ছয় মাস এখন পাই তিন মাস৻ লবণ পানিতে তো আর মাছ হয়না৻
otter
মাছের খোঁজে সুন্দরবনের ভোঁদড়৻
“আগে বনে গোলপাতার কাজ করতাম তিনমাস, এখন একমাসও কাজ করতে পারি না৻ বন্যায় গাছের চারাগুলোই নষ্ট হয়ে গেছে৻``

তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা

No comments:

Post a Comment