Saturday, February 13, 2010

ক্ষতিগ্রস্তরা জানে না ক্ষতির কারণ

‘দেহি তো গাঙ্গে ঘন ঘন বইন্নার সিঙ্গাল (সিগন্যাল)। নদীতে জাল ফেলি আগের মতো মাছ পোনা ওডে না। প্রত্যেক আমবইস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে বাড়িঘর সব তলাইয়্যা যায়। মনে আয় গাঙ্গের পানি আগের চাইতে অনেক ফুইল্লা উঠছে। দ্যাশে যে কি বইন্না শুরু অইছে কইতে পারি না! আগে তো এমুন আছিলো না। মোগো তো এহন মরণের জোগাড়।’ বরগুনার বিষখালী নদী তীরের গ্রাম ডালভাঙার সত্তরোর্ধ্ব জেলে মোসলেম আলী এমন করেই আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত দুর্ভোগ-দুর্দশার কথা বর্ণনা করছিলেন। ডালভাঙা গ্রামের কৃষক শুক্কুর আলী বলেন, ‘এক কানি জমিতে আমন বুনছিলাম। খরচ অইছে ১৩ হাজার টাকা, আর ধান বেচছি মাত্র ১১ হাজার টাকার। আগে এই এক কানি জমিতে যে ধান অইত তা কমপক্ষে ২০-২২ হাজার টাকা বেচতে পারতাম। এই কয় বছর ধইর্যা জমিতে ধানই অয় না। জোয়ারের পানিতে জমি তলাইয়্যা যায়। এহন কৃষি কাম ছাইড়্যা দিমু তাও পারি না, করমু কী? কোনো কামই তো জানি না। চিন্তা করলে খালি মাথাডা ঘোরে, কোনো পথই পাই না।’
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের দক্ষিণ উপকূলের জেলা বরগুনার মানুষের জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার বিষয়টি এভাবে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তন এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকার ক্ষেত্রগুলোকে হুমকির মুখে ঠেলে দিলেও এসব বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো কোনো প্রস্তুতি, সচেতনতা এই এলাকার মানুষের মধ্যে গড়ে উঠছে না। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকেও তেমন কোনো উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।
পরিবেশ সচেতনতা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা জানান, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। আর বাংলাদেশের প্রায় ৪৭ হাজার ২০১ কিলোমিটার আয়তনের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৪৭টি উপজেলার প্রায় চার কোটি মানুষ রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব জেলার মধ্যে অধিক ঝুঁকিতে আছে বরগুনা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বরগুনার সাধারণ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন ও এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তেমন সচেতন না। এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য-উপাত্তও তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। বরগুনার বেশকিছু এলাকা ঘুরে বিভিন্ন পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের পেশায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বঙ্গোপসাগর তীরের গ্রাম নলবুনিয়ার জেলে আবুল হোসেন বলেন, ‘গাঙ্গে আগের নাহান মাছ পাইনাম, বইন্নায় জাল-নৌকা সব গেছিল আবার কর্জ কইর্যা বানাইছি। এহন মাছ পাই না বইল্লা বউ-বাচ্চা লইয়্যা না খাইয়্যা মরণের জোগাড়।’
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে স্থানীয় বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার করলেও তা গ্রামে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষের মধ্যে পৌঁছাচ্ছে না।
জেলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কেন্দ্রের উপপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, আবহাওয়ার নেতিবাচক পরিবর্তন এখন খুব দ্রুততার সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে। গত দুই বছরে সিডর ও আইলার মতো দুটি বড় মাপের ঘূর্ণিঝড় এ অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। গত বছর ছোট-বড় মিলিয়ে ১৮টি ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এ ছাড়া প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, গ্রীষ্মের দাবদাহ সবকিছুতেই একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি উপকূলের জীবনযাত্রা ও জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মানসিক ও অন্যান্য কোনো প্রস্তুতি আমাদের নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের গবেষক মাহবুব হাসান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে উত্তরণের পথ উপকূলের দরিদ্র মানুষগুলো জানে না। তবে মোবাইল ফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলো গ্রাহকসেবার (কাস্টমার সার্ভিস) অংশ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে অবহিত করতে পারে, সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারে। সেটা হতে পারে এসএমএস বা ভয়েস এসএমএসের মাধ্যমে।

No comments:

Post a Comment