জলবায়ু ও পরিবেশ আন্দোলন বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পুরো বিষয়টি এখন সর্বত্র আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক প্রভাবিত দেশগুলোর অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আমাদের জন্য কোনো কাগুজে বিষয় নয়, নির্মম বাস্তবতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোকে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় দারিদ্র্যের তীব্রতা। একটি ঘূর্ণিঝড় বা দুর্যোগের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটি দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। হতদরিদ্র মানুষের ওপর এর প্রভাব তাই পড়ছে মারাত্মকভাবে। ত্রাণ, পুনর্বাসন, সতর্কীকরণ থেকে শুরু করে অন্য সব পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন ও চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাই খাপ খাওয়ানো ও পরিস্থিতি উন্নতির কৌশল (Adaptation and Mitigation Strategy) খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু এগুলো সবই স্বল্পমেয়াদি প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অথচ দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবিলার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী নয়, বরং বিশ্বের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর এই কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রথম ধাপটি হচ্ছে উন্নত ও স্বল্পোন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সব দেশের গ্রিন হাউস গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ কমানো।
যেহেতু বর্তমানে বিশ্ব একটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাই শিল্পায়ন সীমিতকরণের মাধ্যমে এই পদক্ষেপটি নিতে উন্নত দেশগুলো তো বটেই, স্বল্পোন্নত ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোও নারাজ। কেননা, এ জাতীয় যেকোনো কর্মসূচি বিশ্ববাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে উন্নত জীবনযাত্রা ও আধুনিক সরঞ্জামে ভরপুর জীবনাচার থেকে সরে আসতে উন্নত দেশের জনসাধারণ অনাগ্রহী। আর তাদের উন্নত জীবনযাত্রার মানের কারণে ধনী দেশগুলোর জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব কম হওয়ার পরও তাদের মাধ্যমে দূষণের হার গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। জীবনযাত্রার মান নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের এই টানাপোড়েনে সরকার ও জনসাধারণ সবাই পড়েছে উভয় সংকটে। এ কারণেই কোপেনহেগেন সম্মেলন যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয়েছিল, তা কার্যত পূরণ করতে পারেনি।
তবে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের এ ফল একেবারে অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। কারণ, উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ও পরিবেশনীতির মধ্যে একটি স্পষ্ট বিরোধ রয়েছে। তাদের সবচেয়ে বেশি দূষণকারী কলকারখানাগুলো সর্বাধিক শ্রমিক নিয়োগ করে। আবার বর্তমান সময়ে দূষণ কমানোর চেয়ে কর্মসংস্থান বাঁচানো তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে ও পরের ঘটনাগুলো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বস্ততা ও সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে যে যুক্তি ও পাল্টাযুক্তির অবতারণা করেছে, তা একটি আন্তর্জাতিক গেম থিয়োরির প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা যায়।
এ ক্ষেত্রে পক্ষ রয়েছে তিনটি। প্রথমটি অবশ্যই উন্নত বিশ্ব, যার সর্বাধিক শিল্পায়ন ও জীবনযাত্রার মানের কারণে দূষণের সিংহভাগের জন্য দায়ী। দ্বিতীয়টি মাঝারি আয়ের উন্নয়নশীল ও অগ্রসর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো (ভারত, চীন প্রভৃতি), যাদের রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে এবং জীবনযাত্রার মানও ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে। তৃতীয় পক্ষটি হচ্ছে হতদরিদ্র ও নিম্নআয়ের দেশগুলো, যাদের শিল্পায়ন সবচেয়ে কম, জীবনযাত্রার মান সর্বনিম্ন, অথচ অনুপযোগী ও অসচেতন পরিবেশনীতির কারণে দূষণের পরিমাণ একেবারে কম নয়। এই তৃতীয় ধরনের দেশগুলোই আবার পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যক্ষভাবে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ এই তৃতীয় দলটির অন্তর্ভুক্ত। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ আমাদের পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গিন করে তুলেছে।
প্রথম দুই ধরনের দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কেননা, ভারত বা চীনের রপ্তানির সিংহভাগ যায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর চাহিদা মেটাতে। অন্যদিকে বিপুল জনসংখ্যার এ দুটি দেশ আবার আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের অনেকগুলো দেশের পণ্যের বিশাল বাজার। কাজেই একদিকে যেমন উন্নত দেশগুলো ভারত বা চীনের শিল্পায়ন কমানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের আমদানি ব্যয় বাড়াতে পারে না, তেমনি আবার অভ্যন্তরীণ শিল্পায়ন সীমিত করে ও দূষণ কমিয়ে উত্পাদন ব্যয় বাড়িয়ে তাদের রপ্তানিমুখী শিল্পের অর্থনৈতিক সুবিধায় ছাড় দিতে পারে না। আর তাই যেকোনো ‘সবুজ’ পরিবেশনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘অন্যেরা আগে করলেই করা হবে’—এ রকম শর্তাধীন হয়ে পড়ছে। তবে কেউই প্রথম পদক্ষেপটি নিতে রাজি হয় না এ আস্থার অভাবে যে, একবার চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেললে যদি অন্যরা কথা না রাখে তাহলে স্বাক্ষরকারী দেশ বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়বে।
অন্যদিকে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিযোগী। কিন্তু এরা আবার পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। সঙ্গত কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন এবং এ জন্য সংঘটিত দুর্যোগ মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে এসব দেশ যেমন উন্নত ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছে, তেমনি আবার সর্বাধিক দূষণকারী দেশগুলোকে চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে দূষণ হ্রাস করার ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছে।
সমস্যা হলো, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত দিক থেকে আবার এসব দেশ উন্নত তো বটেই, মাঝারি আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকেও অনেক পিছিয়ে আছে। কাজেই পরিবেশ দূষনজনিত পুনর্বাসনের জন্য পাওয়া ক্ষতিপূরণের অর্থ যদি তারা শিল্পায়নের কাজে ব্যয় করে, তবে একদিকে দূষণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, আবার অন্যদিকে সুলভ শ্রমিকের কারণে উত্পাদন ব্যয় কমিয়ে তারা রপ্তানিমুখী শিল্পে মাঝারি আয়ের দেশগুলোর শক্ত প্রতিযোগী হিসেব আবির্ভূত হবে। স্বাভাবিকভাবেই ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো তীব্র প্রতিযোগিতার বিশ্ববাজারে আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে চায় না। ফলে কৌশলগতভাবে তারা কোনো অঙ্গীকার করছে না। এর পাল্টা জবাব হিসেবে উন্নত দেশগুলোও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে চুক্তি স্বাক্ষর করছে না। তাই সার্বিক ফলাফল থেকে যাচ্ছে শূন্য।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোপেনহেগেন সম্মেলনে বাংলাদেশের ব্যাপারে পশ্চিমা সাংবাদিক ও পরিবেশবাদীদের একটি মন্তব্য সবার নজর কেড়েছে। সেটি হলো, ‘বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি স্বাদ আছে: এর স্বাদ নোনতা।’ কেবল বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসই নয়—লবণাক্ততা আমাদের দুর্যোগপীড়িত জনজীবনে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা, যা কেবল কৃষিই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও তৈরি করছে বিপর্যয়। কাজেই যখন একজন প্রথম বিশ্বের নাগরিকের মন্তব্য পড়ি, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে কার্যকরী বন্যানিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দিলে বেশি উপকৃত হবে’, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—আর কতদিন পৃথিবীর ক্ষমতাশালী ধনী দেশগুলো তাদের অবিমৃষ্যকারিতার দায় এড়িয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আগে যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তারচেয়েও বেশি ভয়াবহ হবে। আর এর প্রমাণও পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ অন্যান্য দ্বীপ ও সন্দ্বীপ দেশগুলো। বিগত ডিসেম্বরের (২০০৯) ভয়াবহ তুষারঝড় উত্তরের উন্নত দেশগুলোতেও ডেকে এনেছে অভূতপূর্ব দুর্যোগ। কাজেই এ সমস্যা কোনো ব্যক্তি বা জাতিগোষ্ঠীর নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব এবং আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম। এখনই সর্বতোভাবে সংযমী হয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ আমরা সম্ভবত এড়াতে পারব না।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
হোমায়রা আহমেদ: গবেষক, বিআইডিএস।
< লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ২৩-০১-২০১০ তারিখে প্রকাশিত >
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাই খাপ খাওয়ানো ও পরিস্থিতি উন্নতির কৌশল (Adaptation and Mitigation Strategy) খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু এগুলো সবই স্বল্পমেয়াদি প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অথচ দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবিলার জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী নয়, বরং বিশ্বের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর এই কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রথম ধাপটি হচ্ছে উন্নত ও স্বল্পোন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সব দেশের গ্রিন হাউস গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ কমানো।
যেহেতু বর্তমানে বিশ্ব একটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাই শিল্পায়ন সীমিতকরণের মাধ্যমে এই পদক্ষেপটি নিতে উন্নত দেশগুলো তো বটেই, স্বল্পোন্নত ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোও নারাজ। কেননা, এ জাতীয় যেকোনো কর্মসূচি বিশ্ববাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে উন্নত জীবনযাত্রা ও আধুনিক সরঞ্জামে ভরপুর জীবনাচার থেকে সরে আসতে উন্নত দেশের জনসাধারণ অনাগ্রহী। আর তাদের উন্নত জীবনযাত্রার মানের কারণে ধনী দেশগুলোর জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব কম হওয়ার পরও তাদের মাধ্যমে দূষণের হার গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। জীবনযাত্রার মান নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের এই টানাপোড়েনে সরকার ও জনসাধারণ সবাই পড়েছে উভয় সংকটে। এ কারণেই কোপেনহেগেন সম্মেলন যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয়েছিল, তা কার্যত পূরণ করতে পারেনি।
তবে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের এ ফল একেবারে অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। কারণ, উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ও পরিবেশনীতির মধ্যে একটি স্পষ্ট বিরোধ রয়েছে। তাদের সবচেয়ে বেশি দূষণকারী কলকারখানাগুলো সর্বাধিক শ্রমিক নিয়োগ করে। আবার বর্তমান সময়ে দূষণ কমানোর চেয়ে কর্মসংস্থান বাঁচানো তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে ও পরের ঘটনাগুলো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বস্ততা ও সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে যে যুক্তি ও পাল্টাযুক্তির অবতারণা করেছে, তা একটি আন্তর্জাতিক গেম থিয়োরির প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা যায়।
এ ক্ষেত্রে পক্ষ রয়েছে তিনটি। প্রথমটি অবশ্যই উন্নত বিশ্ব, যার সর্বাধিক শিল্পায়ন ও জীবনযাত্রার মানের কারণে দূষণের সিংহভাগের জন্য দায়ী। দ্বিতীয়টি মাঝারি আয়ের উন্নয়নশীল ও অগ্রসর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো (ভারত, চীন প্রভৃতি), যাদের রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে এবং জীবনযাত্রার মানও ক্রমান্বয়ে উন্নত হচ্ছে। তৃতীয় পক্ষটি হচ্ছে হতদরিদ্র ও নিম্নআয়ের দেশগুলো, যাদের শিল্পায়ন সবচেয়ে কম, জীবনযাত্রার মান সর্বনিম্ন, অথচ অনুপযোগী ও অসচেতন পরিবেশনীতির কারণে দূষণের পরিমাণ একেবারে কম নয়। এই তৃতীয় ধরনের দেশগুলোই আবার পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রত্যক্ষভাবে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ এই তৃতীয় দলটির অন্তর্ভুক্ত। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ আমাদের পরিস্থিতিকে আরও সঙ্গিন করে তুলেছে।
প্রথম দুই ধরনের দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কেননা, ভারত বা চীনের রপ্তানির সিংহভাগ যায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর চাহিদা মেটাতে। অন্যদিকে বিপুল জনসংখ্যার এ দুটি দেশ আবার আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের অনেকগুলো দেশের পণ্যের বিশাল বাজার। কাজেই একদিকে যেমন উন্নত দেশগুলো ভারত বা চীনের শিল্পায়ন কমানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের আমদানি ব্যয় বাড়াতে পারে না, তেমনি আবার অভ্যন্তরীণ শিল্পায়ন সীমিত করে ও দূষণ কমিয়ে উত্পাদন ব্যয় বাড়িয়ে তাদের রপ্তানিমুখী শিল্পের অর্থনৈতিক সুবিধায় ছাড় দিতে পারে না। আর তাই যেকোনো ‘সবুজ’ পরিবেশনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘অন্যেরা আগে করলেই করা হবে’—এ রকম শর্তাধীন হয়ে পড়ছে। তবে কেউই প্রথম পদক্ষেপটি নিতে রাজি হয় না এ আস্থার অভাবে যে, একবার চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেললে যদি অন্যরা কথা না রাখে তাহলে স্বাক্ষরকারী দেশ বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিছিয়ে পড়বে।
অন্যদিকে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিযোগী। কিন্তু এরা আবার পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। সঙ্গত কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন এবং এ জন্য সংঘটিত দুর্যোগ মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে এসব দেশ যেমন উন্নত ও মাঝারি আয়ের দেশগুলোর কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছে, তেমনি আবার সর্বাধিক দূষণকারী দেশগুলোকে চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে স্থায়ীভাবে দূষণ হ্রাস করার ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছে।
সমস্যা হলো, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত দিক থেকে আবার এসব দেশ উন্নত তো বটেই, মাঝারি আয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকেও অনেক পিছিয়ে আছে। কাজেই পরিবেশ দূষনজনিত পুনর্বাসনের জন্য পাওয়া ক্ষতিপূরণের অর্থ যদি তারা শিল্পায়নের কাজে ব্যয় করে, তবে একদিকে দূষণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, আবার অন্যদিকে সুলভ শ্রমিকের কারণে উত্পাদন ব্যয় কমিয়ে তারা রপ্তানিমুখী শিল্পে মাঝারি আয়ের দেশগুলোর শক্ত প্রতিযোগী হিসেব আবির্ভূত হবে। স্বাভাবিকভাবেই ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো তীব্র প্রতিযোগিতার বিশ্ববাজারে আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে চায় না। ফলে কৌশলগতভাবে তারা কোনো অঙ্গীকার করছে না। এর পাল্টা জবাব হিসেবে উন্নত দেশগুলোও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে চুক্তি স্বাক্ষর করছে না। তাই সার্বিক ফলাফল থেকে যাচ্ছে শূন্য।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোপেনহেগেন সম্মেলনে বাংলাদেশের ব্যাপারে পশ্চিমা সাংবাদিক ও পরিবেশবাদীদের একটি মন্তব্য সবার নজর কেড়েছে। সেটি হলো, ‘বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি স্বাদ আছে: এর স্বাদ নোনতা।’ কেবল বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসই নয়—লবণাক্ততা আমাদের দুর্যোগপীড়িত জনজীবনে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রা, যা কেবল কৃষিই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও তৈরি করছে বিপর্যয়। কাজেই যখন একজন প্রথম বিশ্বের নাগরিকের মন্তব্য পড়ি, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে কার্যকরী বন্যানিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দিলে বেশি উপকৃত হবে’, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—আর কতদিন পৃথিবীর ক্ষমতাশালী ধনী দেশগুলো তাদের অবিমৃষ্যকারিতার দায় এড়িয়ে যাবে।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশবিজ্ঞানীরা একমত হয়েছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আগে যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তারচেয়েও বেশি ভয়াবহ হবে। আর এর প্রমাণও পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ অন্যান্য দ্বীপ ও সন্দ্বীপ দেশগুলো। বিগত ডিসেম্বরের (২০০৯) ভয়াবহ তুষারঝড় উত্তরের উন্নত দেশগুলোতেও ডেকে এনেছে অভূতপূর্ব দুর্যোগ। কাজেই এ সমস্যা কোনো ব্যক্তি বা জাতিগোষ্ঠীর নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব এবং আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম। এখনই সর্বতোভাবে সংযমী হয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ আমরা সম্ভবত এড়াতে পারব না।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
হোমায়রা আহমেদ: গবেষক, বিআইডিএস।
No comments:
Post a Comment