উপকূলীয় মাছের বন্দরে মন্দাভাব
বাংলাদেশে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপ বেড়ে ঝড়ঝঞ্ঝার প্রকোপ বছরে বছরে বাড়ছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন এসব ঝড়-জলোচ্ছ্বাস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান একটি উপসর্গ৷ আর এ দূর্যোগে জীবিকা নিয়ে তীব্র সঙ্কটে পড়েছেন উপকূলের জেলে সম্প্রদায়৻
কুয়াকাটার অদূরে গ্রাম খাজুরাহ ৷ এ গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ সাগরে মাছ ধরে জীবিকা চালান৷ তবে
মাঝে মধ্যে কেউ কেউ আর ফেরেননা ৷ তেমনি একজন শামসুল আলী আকন্দ৷ গত বর্ষা মৌসুমে ঝড়ে পড়ে তার নৌকা ডুবে যায় ৷
মাঝে মধ্যে কেউ কেউ আর ফেরেননা ৷ তেমনি একজন শামসুল আলী আকন্দ৷ গত বর্ষা মৌসুমে ঝড়ে পড়ে তার নৌকা ডুবে যায় ৷
স্বামীর সাথে শেষ দেখার ক্ষণটির স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে তার বিধবা স্ত্রী পিয়ারী বেগম বলছিলেন হাতে ৪০০ টাকা তুলে দিয়ে ভোরের আজানের সাথে বেরিয়ে গিয়েছিলেন শামসুল আলী৻ আর ফেরেননি৻
পিয়ারী বেগম দিশেহারা এতগুলো সন্তান নিয়ে |
সাতদিন পর তিনি খবর পান তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে ভোলা জেলার ঢালচর এলাকায় ৷ লোকমুখে পিয়ারী বেগম শুনেছেন যে তার স্বামীকে ঢালচরের এক মসজিদের পাশে দাফন করা হয়েছে, কিন্তু পয়সা খরচ করে অতদূর গিয়ে আর তার দেখা হয় নি৻
স্বামীর মৃত্যুর পর আট ছেলেমেয়ের বড় দুজন কাজ ক`রে যা আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে৷ অভাবে পড়ে ১২ বছরের ছেলেকে পাঠিয়েছেন মাছের ট্রলারে৷
স্বামীর মৃত্যুর পর যে ট্রলারে তিনি মাছ ধরতে গিয়েছিলেন তার মালিক পিয়ারী বেগমকে এক বস্তা চাল আর দু`বারে মোট ৬০০০ টাকা দিয়েছেন৻ তিনি এখন খোঁজও নেননা৻ অন্য কারো কাছ থেকেও কোন সাহায্য পান নি বিধবা পিয়ারী বেগম৻ এতগুলো সন্তান নিয়ে এখন অনেকটা দিশেহারা অবস্থা তার৻
জুন থেকে মাঝ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলে বরাবরই কম বেশী সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হয়৻ তবে সম্প্রতি এসব ঝড়ের সংখ্যা অনেকটা বেড়েছে৻
বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তরের উপ পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম হিসেব দিলেন, বছর দশেক আগ পর্যন্ত যেখানে বছরে গড়ে ছ` থেকে সাতটি ঝড়ের সৃষ্টি হত, ২০০৫ এ তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬তে৻ ২০০৬ সালে ১৪টি , ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৫ ও ২০ এ৻
মি. আলম বললেন তাদের পর্যবেক্ষন, সাগরের তাপমাত্রা বাড়ছে বলেই এধরণের ঝড়ের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে৻
সাগরের এই ক্রমবর্ধমান উত্তাল আচরণে জেলেদের জানমালের ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, বিপদগ্রস্থ হচ্ছে তাদের জীবিকা৷ কারণ আবহাওয়া দপ্তর থেকে সতর্ক সঙ্কেত তিন নম্বরে পৌঁছুলেই মাছ ধরা বাদ দিয়ে জেলেদের ছুটে আসতে হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে৷ আর বছরে বছরে বাড়ছে সতর্কতার সংখ্যা৻
কুয়াকাটার কাছে আলীপুর মাছের আড়ত৻ সমুদ্র থেকে বেরিয়ে আসা এক খাঁড়ির তীরের এই বাজারটিকে একটি পোতাশ্রয়ের মত লাগে৻ সমুদ্রগামী মাছের নৌকো বা ট্রলারগুলো মাছ ধরে এখানে এসে ভেড়ে, আবার এখান থেকেই সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়৻
জেলেদের জীবিকা বিপদগ্রস্থ হচ্ছে |
সারি সারি নোঙর করে রাখা সব ট্রলার৻ মাঝি, জেলেদের সাথে কথা বলতেই বোঝা গেল ঝড়ের প্রকোপে জীবিকা নিয়ে কতটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা৻ সাহানা নামের একটি ট্রলারের চালক আবুল কাশেম কুড়ি বছর ধরে সাগরে যান মাছ ধরতে৷ বললেন, গত তিন-চার বছরে সাগরে ঝড় অনেক বেড়ে গেছে৻
আবুল কাশেম কুড়ি বছর ধরে সাগরে যান মাছ ধরতে৷ তিনি বলছেন যে আজকাল প্রায়শই ঝড়ের সিগনালে পড়তে হয় তাদের৻ একই কথা বললেন, পাশের ট্রলারের মাঝি মোহাম্মদ হানিফ৻ ‘বাজার করে সাগরে যাওয়ার পাড়ি জমানোর দুদিনের মাথাতেই সিগনাল ওঠে`৻
মোহাম্মদ হানিফ হিসেব দিলেন তেল, বরফ, খাবার নিয়ে সাগরে এক দফাতেই খরচ হয় পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার টাকা৻ সিগনাল শুনে হঠাত ফিরে আসলে পুরো টাকাটা নষ্ট হয়৻
উদ্বিগ্ন মাঝিরা বললেন এভাবে বারবার ঝড়ের সিগনাল শুনে ফিরে আসাতে আয় যেমন কমছে, মালিক মহাজনের কাছে দিন দিন ঋন বাড়ছে৻
জেলেদের অনেকে বললেন, ইদানিং বছরের ছয় মাসই তাদের বসে থাকতে হচ্ছে৻ ফলে বছরের বাকিটা সময় যাচ্ছে ঋণ শোধ করতে করতে৻
শুধু মাঝি জেলেরা নয়, ট্রলার মালিক, মহাজনরাও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ছেন কতদিন তারা এই ব্যবসায় থাকতে পারবেন৷
মোহাম্মদ দুলাল হোসেন হাওলাদার তিনটি ট্রলারের মালিক৻ তিনি বললেন যে মাঝি-জেলেদের সব রসদ-বাজারসদাই করে সমুদ্রে পাঠানোর জন্য প্রায়ই তাদের বড় ধরনের দেনা করতে হয়৻
দুলাল হাওলাদার বললেন গত বছর ঝড়ের কারণে জেলেদের ফিরে আসতে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বার৻ আর এতে তার লোকসান হয়েছে ১০-১২ লক্ষ টাকা৻ তিনি বললেন, অনেক মালিক এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় ঢুকছেন৻
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা
No comments:
Post a Comment