Saturday, February 13, 2010

বৈরি জলবায়ুর বড় শিকার বাংলাদেশ

ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে গত ৭ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন। এ সম্মেলন চলবে ১৮ তারিখ পর্যন্ত। এতে যোগ দিচ্ছেন ১৯২টি দেশের প্রতিনিধিরা। দুই সপ্তাহব্যাপী এই সম্মেলনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনা, দরিদ্র দেশগুলোর জন্য এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য তহবিল গঠন- এসব নিয়েই আলোচনা করবেন তারা। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ জলবায়ু সমস্যায় শঙ্কিত। ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহাদেশগুলোর পানির মজুদ শুকিয়ে যাবে, ক্ষেত-খামার মরুভূমিতে পরিণত হবে। প্রাণীকুলের অর্ধেকের বেশি প্রজাতি হারিয়ে যাবে, অগণিত প্রাণী বাসস্থান হারাবে এবং কোনো কোনো জাতি সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
জাতিসংঘের প্রধান পরিবেশ কর্মকর্তা ইয়োভো ডি বোয়ায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের সামনে প্রশ্ন চারটি- ১. শিল্পোন্নত দেশগুলো কতটা বেশি হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে রাজী, ২. চীন ও ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশ কতটা কমাবে ৩. ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তার তহবিল আদায়ে কীভাবে উন্নত দেশগুলোকে জড়িত করা হবে এবং ৪. কীভাবে এই তহবিল খরচ করা হবে। এছাড়া বিশ্বের তাপমাত্রা বর্তমান অবস্থান বজায় রাখা এবং জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলা বৈশ্বিক কর্মকৌশল প্রণয়ন করা।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রী সম্মেলনে যোগ দেবার আগে গণমাধ্যমকে বলেন, সম্মেলনে আমাদের দাবি হবে, আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আনুদান হিসেবে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার এই সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে জানা গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে জলবায়ু দূষণ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ উন্নত দেশগুলো। আর তার বিষক্রিয়ার শিকার হতে হয় উন্নয়নশীল দেশের মানুষদের।

দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। জলবায়ুর শকুনি থাবা গেড়ে বসেছে আমাদের বাংলাদেশেও। উপকূলীয় অঞ্চলের দু’ফসলি জমিগুলো এখন এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। লবণাক্ততা আর জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির পাবার ফলে উপকূলের কৃষি জমি কমে গেছে। আর এই লবণাক্ততা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাগারের বুকে হারিয়ে গেছে ভোলার ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা। বরিশালেও ফসল উৎপাদন কমে গেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি। 
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চলছে পানির ভয়াবহ সংকট। পানির স্তর নেমে গেছে অনেক নিচে। যমুনা অববাহিকার জেলাগুলোতে প্রত্যেক বছর বন্যার কবলে পড়ছে মানুষ। আবার দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো বছর বন্যার নামে কোনো খবরই নেই। পানির অভাবে ব্যাহত হয় উৎপাদন। প্রকৃতির বৈরি আচরণ আজ পৃথিবীর সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। আমরা জানি যে, ভৌগলিক কারণে দেশের সবচেয়ে কম তাপমাত্রা থাকা দরকার ছিল সিলেটে। অথচ বৈরি জলবায়ুর কারণে গত দশ বছরে রাজশাহী ও খুলনায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রয়েছে। শীত বাড়ছে। বাড়ছে কুয়াশার প্রভাব। এক কথায় গোটা বাংলাদেশ জুড়েই খরা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, টর্নেডোর প্রকোপ বাড়ছে। আর এসব কারণে মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, সামাজিক জীবন, কৃষি, মৎস্য, সার্বিক জীববৈচিত্র পড়েছে ভয়াবহ হুমকির মুখে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কমছে কৃষি ও বাসযোগ্য জমি।
বাড়ছে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারত্ব ও সামাজিক অস্থিরতা। গবেষকরা বলেছেন, যে হারে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে এবং যেভাবে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে তাতে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ ভূমি সাগরের মধ্যে হারিয়ে যাবে। এর মধ্যে কুতুবদিয়া আগামী ৪০ আর ভোলা ৭০ বছরে ডুবে যাবে। এসব কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বের দশটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের দ্বিতীয়টি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্রিটেনের ‘দি ইন্ডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার সাংবাদিক জোহান হ্যারি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ : রক্তে জন্ম, জলে বিনাশ’। ঢাকার কাছের জেলা মুন্সীগঞ্জে পর্যন্ত লবণাক্ত পানি এবং এর প্রভাবে মানুষ, জীবজন্তু, গাছ ও মাছের মৃত্যুর তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে।
২০০৭ সালে প্রকাশিত আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, সমুদ্র’র ৬৭ সে.মি. বাড়লে বাংলাদেশের গর্ব এবং অনেক বিপদের রক্ষাকবচ ‘সুন্দরবন’ ও সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ ‘লোহাচরা’ ও ‘সুপারিভাঙ্গা’ নামের দু’টি দ্বীপ সমুদ্রে হারিয়ে গেছে। জাতিসংঘের আইইউসিএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য আজ বিপন্ন। ৬৩২টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ২২টি উভচর প্রাণীর মধ্যে ৮টি, ১২৬টি সরীসৃপ প্রজাতির মধ্যে ১৪টি বিলুপ্তির পথে। স্তন্যপায়ী ১২০টি প্রজাতির মধ্যে ১৩টি বিপন্ন আর ২২টি বিলুপ্তির পথে। ৭০৮টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টি বিপন্নপ্রায়। ১১০টি পশুর প্রজাতির মধ্যে ৪০টি ও ৫ হাজার প্রজাতির গাছের মধ্যে ১০৬টির অস্তিত্ব প্রায় নেই।
২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যাবে। একই কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ২২ ভাগ কৃষি জমি ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে খাদ্যসংকট চরম আকার ধারণ করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, রাজধানী ও আশপাশ এলাকার শিল্প-কারখানা থেকে ৬২ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিতে পড়ছে। এর ফলে বছরে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে ৪ হাজার শিশু মায়ের গর্ভেই মারা যাচ্ছে। আর পরিবেশ দূষণের কারণে ৭০ লাখ মানুষ নানা রোগে ভুগছে। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন আর উষ্ণায়নের মূল কারণ কার্বনডাই-অক্সাইড নিঃসরণ। আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশ। তাদের পরিবেশ বিধ্বংসী কারখানা এবং ভোগবাদী জীবনধারা- যা অধিক পরিমাণে কার্বনডাই-অক্সাইড উৎপাদন করছে। এর ফলে বায়ু ও সমুদ্রের উপরিভাগ গরম হচ্ছে। ফলে গলছে মেরু অঞ্চল এবং পাহাড়ে জমে থাকা বরফ। আর এর কারণে একদিকে সমুদ্রস্তর বাড়ছে। অন্যদিকে পাহাড়ি ঢলসহ ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। বাড়ছে সাইক্লোন, টর্নেডোসহ সামুদ্রিক ঝড়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নদীশাসনে সহনশীল হওয়া ও নিয়মিত নদী খনন, সামাজিক ও উপকূলীয় বনায়ন, পর্যাপ্তসংখ্যক সাইক্লোন শেল্টার ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, আক্রান্তদের পুনর্বাসন, জলবায়ু পরিবর্তিত পরিস্থিতি উপযোগী ফসল উদ্ভাবন ইত্যাদির মাধ্যমে বিপদাপন্নতা মোকাবিলা সম্ভব। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করা। অন্যথায় মানবসভ্যতা সুরক্ষা সম্ভব হবে না।

-লেখক: তুষার সরকার
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ ডিসেম্বর ২০০৯।

No comments:

Post a Comment