Thursday, February 11, 2010

ব্যর্থ হলে আমাদের সন্তানেরা ক্ষমা করবে না


ইতিহাসজুড়ে মানবের সমস্ত প্রগতি ঘটেছে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের স্বপ্ন আর বাধা অতিক্রমের লড়াকু মানসিকতার জন্য। অনেকে তখন বলেছে, এমন স্বপ্ন আমাদের আওতার বাইরে, এসব বাধা অনতিক্রম্য। তার পরও মানুষ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছে, বাধা অতিক্রমের লড়াই চালিয়ে গেছে।
আজ আমরা এমন এক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে, কিছুদিন আগেও যার সমাধান আমাদের আওতার বাইরে বলে মনে হতো, মতে হতো তা এক অসম্ভব, ব্যয়সাপেক্ষ ও অনুপযুক্ত ব্যাপার। তবে দাসত্ব, নারী নিপীড়ন, কর্মসংস্থানহীনতা বা পারমাণবিক যুদ্ধের মতোই জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর বশে আনা অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। সামনের দুই সপ্তাহজুড়ে সত্যিকারের এক বিশ্ব সম্প্রদায় হিসেবে আমরা একত্র হব—এর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য দরকারি প্রথম সিদ্ধান্তসূচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
আর এখন কোপেনহেগেন সমঝোতার পথে নরওয়ে ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ব্রিটেন একধাপ এগিয়ে একটি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং এর তীব্রতা কমাতে দীর্ঘ মেয়াদে সম্পদ সেসব দেশে স্থানান্তরের একটি কাঠামো আমরা প্রকাশ করতে যাচ্ছি।
বড় ধরনের যেসব বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যপ্রমাণ কোপেনহেগেন সম্মেলনের ভিত্তি, সেগুলো নিয়ে সবার সংশয় দূর হোক। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ সারা দুনিয়ার চার হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানীকে একসঙ্গে নিয়ে এসেছে। তাঁদের সাম্প্রতিক কাজ মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিপুল ও বৈচিত্র্যময় সাক্ষ্যকে আরও শাণিত করেছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্র থেকে কিছু ই-মেইল ফাঁস হওয়ায় তাঁদের কাজের যুগান্তকারী তাত্পর্যকে হেলা করা যায় না। বিপরীত দিকে, ই-মেইল নিয়ে এ ক্ষতিকর বিজ্ঞানবিরোধী বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমাদের ঝুঁকিগুলোরই উন্মোচন ঘটিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনকে যারা অস্বীকার করতে চায় তাদের প্রচারণার উদ্দেশ্য পরিষ্কার; এই ক্ষণে এ বিরূপতা কোনো কাকতালীয় নয়। অস্থিরতা তৈরি করতে এবং কোপেনহেগেনে যেসব দেশ যোগ দিচ্ছে, তাদের প্রচেষ্টাকে ক্রমশ দুর্বল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে তা করা হয়েছে।
এর কারণ হলো, আমরা যদি দরকারি এ উচ্চাভিলাষী সমঝোতায় পৌঁছাতে পারার রাজনৈতিক সদিচ্ছার সম্মিলন ঘটাতে পারি, তাহলে কোপেনহেগেন গভীর ঐতিহাসিক রূপান্তরের সূচনা করতে পারে: গত ২০০ বছর আমরা যে পথে হেঁটেছি তা উল্টে দিয়ে।
এ সময়কালে সমৃদ্ধির জন্য আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ও গাছ কাটার ওপর নির্ভর করেছি। এখন আমাদের সম্পদ আহরণ ও জীবনমানের জন্য এমন পথে যেতে হবে, যা বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ না বাড়িয়ে বরং শোষণ করবে। সোজা কথায়, আমাদের স্বল্প কার্বন অর্থনীতি (low carbon economy) গড়তে হবে। শুধু দেশের ভেতর নয়, সারা দুনিয়ার সব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিতে এমনটা করার লক্ষ্য আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে।
একটা বদল জরুরি হয়ে উঠবে: শক্তির ক্ষেত্রে তেল ও জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যমান একাধিপত্যের জায়গায় স্বল্প কার্বন শক্তিব্যবস্থার দক্ষতা, স্বনির্ভরতা ও নিরাপত্তার বিষয় সামনে আসবে। এমন শক্তিব্যবস্থা সামনের দশকগুলোতে অর্থনৈতিক বিকাশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।
বৈশ্বিক ও জনস্বার্থে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রগতির প্রতিটি মহত্ প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের দেখা মিলবে, যারা এসবের বিরোধিতা করতে চাইবে। আর তাই প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টিকারী পরিবেশের ধ্বংসকামী সব বিজ্ঞানবিরোধী ও জলবায়ুবিরোধীর মোকাবিলা আমাকে সাক্ষ্যপ্রমাণ, যুক্তি ও নৈতিক ভাবাবেগ দিয়ে করতে হবে। দুই সপ্তাহব্যাপী আলোচনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের কী অর্জন করতে হবে, সে বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের অবস্থান পুরোপরি পরিষ্কার। আমাদের লক্ষ্য একটি সমন্বিত ও বৈশ্বিক সমঝোতা, যা অনধিক ছয় মাসের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনত মানতে বাধ্য একটি চুক্তির রূপ নেবে। এ সমঝোতায় এমন পথ বেছে নিতে হবে, যেন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হয়। অর্থাত্ ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সবচেয়ে গরিব ও নাজুক দেশগুলোকে অবশ্যম্ভাবী জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অবশ্যই সহায়তা করতে হবে। যদিও সম্প্রতি বেশ অগ্রগতি ঘটেছে, তবুও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। প্রথমত, প্রতিটি রাষ্ট্রকে কার্বন নির্গমন কমানো এবং নির্গমন বৃদ্ধির হার বিষয়ে অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে তাদের আকাঙ্ক্ষা অনেক বড় রাখা দরকার। অনেক দেশের প্রস্তাব অন্য দেশের সঙ্গে শর্তযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কথা বলা যেতে পারে। ইইউ অঙ্গীকার করেছে, সার্বিকভাবে জোরদার কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো গেলে এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নির্গমন কমাবে। অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও এ ধরনের প্রস্তাব রেখেছে। তাই কোপেনহেগেনে সব দেশ যেন তাদের আকাঙ্ক্ষাটা অনেক বড় রাখে, সেটি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে—যেন অন্য দেশও এমন পদক্ষেপ নিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, অর্থসংস্থানের বিষয়ে আমাদের একটি সমঝোতা দরকার, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে উন্নয়নশীল বিশ্বকে সহায়তা করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও তীব্রতা হ্রাস করতে অর্থ প্রয়োজন। এ অর্থ দরকার হবে স্বল্প কার্বনশক্তি, পরিবেশের জন্য অনুকূল প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশগুলোর বন বিনষ্টি আমূল কমাতে বিনিয়োগ করার জন্য।
এ জন্যই সম্প্রতি কমনওয়েলথ সভায় আমি একটি কোপেনহেগেন লঞ্চ ফান্ড গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যেখান থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। কমনওয়েলথ এ প্রস্তাবে সায় দেয়। আমি খুব খুশি যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চুক্তিতে পৌঁছাতে সহায়তার জন্য শুধু কোপেনহেগেনেই যাচ্ছেন না; বরং এতে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুডের পাশাপাশি তিনি তাঁর দেশের ন্যায্য পাওনা চুকিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এ সপ্তাহে আমি পুরো ইইউকে এমন আহ্বান জানাব।
আমাদের যৌথ বিবৃতিতে যেমন বলা আছে, তেমনি কোপেনহেগেনেও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও তীব্রতা হ্রাস করাতে সহায়তা করতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থসংস্থানের বিষয়টি তুলে ধরা দরকার। বৈশ্বিক নির্গমন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামিয়ে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। কিন্তু এ জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আস্থার সঙ্গে নিজেদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা করতে সক্ষম হতেই হবে। তাই ‘ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রদান’ করার ব্যবস্থা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। এ ব্যবস্থায় স্বল্প কার্বন টেকসই বন রক্ষার পরিকল্পনাগুলোর নির্গমন কমানোতে যে ভূমিকা রাখবে, তার বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করা হবে।
তৃতীয়ত, আমাদের একটি ‘স্বচ্ছতার কৌশল’ তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে প্রতিটি দেশ শুধু নিজের ভূখণ্ডে নয়, অন্য দেশে কী ঘটছে তা পরিষ্কারভাবে দেখতে পারবে। পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষার এ মহত্ বৈশ্বিক প্রকল্পে আমাদের অন্য সবাইকে আস্থায় আনা দরকার।
বিশ্বনেতাদের কোপেনহেগেনে যাওয়া উচিত, এ কথা যখন আমি প্রথম তুলি, আমি নিশ্চিত করতে চেয়েছি ব্যর্থতার জায়গা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে। এখন শতাধিক নেতা অংশ নিচ্ছেন। এ সম্মেলনের শেষে আমরা যদি উচ্চাভিলাষী কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারি, তবে এর জন্য এ প্রজন্মকে আমাদের সন্তানেরা ক্ষমা করবে না। সফল করার জন্য আমরা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করে যাব। কখনো ইতিহাস তার সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়। আমাদের সবার স্বার্থে ২০০৯ সালের এই সন্ধিক্ষণ সত্যিকারের হতে হবে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
গর্ডন ব্রাউন: ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। 
< লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ১০-১২-২০০৯ তারিখে প্রকাশিত >

No comments:

Post a Comment