পরিবেশ বদলের হাতিয়ার ভাসমান চাষ৻
আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরনে ক্রমশ: উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশে৷ বিশেষ করে অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা ক্রমে একটি প্রবণতা হিসেবে দাড়িয়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছেন৷ আর এই প্রতিকুলতার সাথে কৃষিকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় ভাবা হচ্ছে বহু পুরোনো কিন্তু প্রায় অজানা এক চাষাবাদ পদ্ধতির কথা ৷
“এই হচ্ছে বেহুলা নদী, আমরা এই তিন উপজেলার মোহনায় আছি৻ একপাশে পিরোজপুরের নাজিরপুর থানা, আর অন্যদিকে স্বরূপকাঠি থানা৻ আর ঐ যে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো বরিশালের বানারীপাড়া থানা৻`` পিরোজপুরের মুগারজর লঞ্চঘাট থেকে ইঞ্জিনের নৌকোয় সঙ্গী হলেন স্থানীয় যুবক জাহিদ৷
নদী ধরে এগুতেই সরু খাল. তার পর বিশাল এক বিল ৷ কেবল জোয়ার লাগছে শুরু করেছে তখন৷ ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল ধুসর শুকনো কচুরিপানার সারি সারি ধাপ ৷
ধাপের ওপর সবুজ লকলকে সব সবজীর চারা৷ হাঁটু পানি, কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে, নৌকোয় বসে সেই সব চারার পরিচর্যা করছিলেন বেশ ক‘জন৷
বরিশাল এবং পিরোজপুরের একটা অংশ বছরের প্রায় ছয় সাত মাস পানিতে ডুবে থাকে, এদের আশে পাশে বিল, নদী-নালা৻ এ কারণে বহু আগ থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ ধাপ চাষ করেন৻ অর্থাৎ, কচুরীপানা দিয়ে ধাপ বানিয়ে তারা এর উপরে বিভিন্ন সবজী চাষ করেন৻ তারা সবজীর চারা তৈরী করেন এবং সেই চারা পুরো বাংলাদেশে যায়৻
কিন্তু কিভাবে এই চাষবাষ করা হয়?
কৃষক আবদুস সামাদ জানান, ``বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে আমরা এই জমিতে কচুরীপানার চাষ করি৻ বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রলার, নৌকোয় করে কচুরী এনে চাষ করি৻ পরে যখন আষাঢ়, শ্রাবণ বা আশ্বিন মাস আসে তখন ধাপ বেঁধে, তার উপর চারা তৈরী করি৻“
মি. সামাদ বলেন, চলতি মৌসুমে তিনি লাউ, বেগুন, মরিচ, টমেটো, করলা ইত্যাদির চারা তৈরী করেছেন৻ তাঁর ফার্মে সবধরনরে চারাই রয়েছে বলে তিনি জানান৻
তিনি জানান আগে এখানে ধান হতো না৻ কারন এই এলাকায় ডাঙ্গা কম, নদীনালা খালবিল বেশী৻ এই ধাপ চাষ তাদের বাপ-দাদারা এটাই করে আসছিলেন৻ তাদের কাছে থেকেই তারা এই চাষাবাদ শিখেছেন৻
মি. সামাদ জানান তিনি সুনামগঞ্জ থেকে এই চাষা পদ্ধতির ব্যাপারে আরও প্রশিক্ষণ নেন৻
``কৃষি অফিসারদের সাহায্যে এই প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছি আমি৻ ধাপ কিভাবে বাধঁতে হয় তা দেখিয়েছি৻ পরে খবর নিয়ে দেখেছি সেখানে চারা খুব ভাল হয়েছে৻“
জলের ওপর চাষাবাদের এই পদ্ধতি নিয়ে নীরিক্ষা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে, কারন বৃষ্টির আচরন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে৷
বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তরের উপপরিচালক শাহ আলম বলেন, “হঠাৎ দেখা গেল একদিনেই অনেক বৃষ্টি হলো৻ যেমন গত বছরে আমরা দেখেছি মাত্র ছয় ঘণ্টায় তিনশো সত্তর মিলি মিটার বৃষ্টি হয়েছে৻ এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা৻
‘‘বৃষ্টিপাতেও একই ধরনের প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে৻ মৌশুমী বৃষ্টির প্যাটার্নেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে৻ যেমন বর্ষা মৌশুম শুরু হয় দেরীতে, কোন বছর আগেই শেষ হয়ে যায়৻ আবার কোন বছর মাঝখানে থেমে যাচ্ছে,“ তিনি বলেন৻
আর বৃষ্টিপাতের এই অনিশ্চিত, অস্বাভাবিক আচরনের কারনে অসময়ে বন্যার আশঙ্কা বাড়ছে বলেন মনে করেন জলবায়ুর গবেষক ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ৻
তিনি বলেন, একটা আগাম বন্যার পাশাপাশি দেরীতে বন্যার সম্ভবনাও তুলনামূলকভাবে বেড়ে যেতে পারে বাংলাদেশে৻ এর লক্ষণগুলোও খুব স্পষ্ট৻
‘‘২০০৭ সালে আমরা এ ধরনের একটা পরিবর্তিত বন্যার চেহারা দেখেছি৻ তবে বন্যাটা খুব বেশী জায়গা জুড়ে না হলেও, মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশের বেশ কিছু জায়গায় একটা বন্যা হয়েছে জুলাইয়ের প্রথম বা জুনের শেষে, আর একটা হয়েছে সেপ্টেম্বরের দিকে৻ যার ফলে আমন ধান বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল৻ সে কারণে ২০০৮ সালে আমাদের ব্যপকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়েছিল৻ এরকম ঘটনা ঘটার সম্ভবনাটা এখন বেড়েছে৻“
যশোরের কেশবপুর উপজেলার ত্রিমোহনী ইউনিয়নে কপোতাক্ষ নদীর পাড় দিয়ে মটর সাইকেলে যেতে যেতে স্থানীয় এনজিও কর্মী হাফিজুর রহমান বলছিলেন নদীতে পলি পড়ে পানি উপচে একসময়কার সমৃদ্ধ এলাকাটি কিভাবে দুর্গত হয়ে পড়েছে৷
তবে তিনি বলেন, তারা এখানে খুব একটা বেশী সফল হতে পারেননি৻ যে ১০০ জন চাষীকে বাছাই করা হয়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র ৩০ জন ধাপচাষের সাথে এখন জড়িত আছেন৻
ফেরার পথে হাফিজুর রহমান বলছিলেন, এবার আঁটঘাট বেধে নেমেছেন তারা৷ কেশবপুরের ৬০০ কৃষককে বাছা হয়েছে৷ পিরোজপুর থেকে দক্ষ ধাপাচাষী এনে এদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে৷ নৌকো, বাঁশ, দড়ির ব্যাবস্থা করে দেয়া হবে৷ এমনকি প্রাথমিকভাবে ধাপের ফসল বাজারজাত করার ব্যাবস্থাও তারা করবেন৷
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা
No comments:
Post a Comment