জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আমি বহু বছর থেকে কাজ করে আসছি। প্রথমে গবেষক হিসেবে আমার দেশ বাংলাদেশে, পরে আন্তর্জাতিক স্তরে। আফ্রিকার ঊষর অঞ্চলে, হিমালয় পর্বতে এবং এশিয়ার বদ্বীপগুলোর বিপুল বিস্তৃত নিম্নভূমিতে কীভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, তা আমি চাক্ষুষ করেছি। বছরের পর বছর আমি জাতিসংঘের নিষ্ফল জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনও দেখেছি। এগুলো কোনো অবদানই রাখতে পারেনি, কারণ আলোচকেরা আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বদলে সংকীর্ণ জাতীয় ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতেই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন।
যাঁরা বলেন, জলবায়ু বদলাচ্ছে না, তাঁদের বেশির ভাগই বিভিন্নভাবে পরিবেশদূষণকারী কলকারখানার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের সঙ্গে আমি মৌখিকভাবে বহু তর্ক করেছি। জীবনে তাঁরা সেসব গ্রামীণ বা শহুরে বসতিগুলোতে পা রাখেননি, যেখানে এরই মধ্যে জলবায়ু বিপর্যয়ের ছাপ ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এসব জায়গায় এলে তাঁরা হয়তো বুঝতে পারতেন, যেসব মানুষ এই বৈশ্বিক হুমকি সৃষ্টির জন্য বিন্দুমাত্রও দায়ী নয়, তাদের কী রকম খেসারত দিতে হচ্ছে। এর জন্য দায়ী ওই সব অস্বীকারকারী মানুষের চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপ।
জলবায়ু সম্মেলন চলতে থাকা কোপেনহেগেনের এই ডিসেম্বরে, আমরা আমাদের চরম বিন্দুতে পৌঁছে গেছি। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, আগামী সময় কোপেনহেগেনকে মনে রাখবে। তবে তা ১৮ ডিসেম্বর সেখানে বিশ্বনেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের জন্য নয়, মনে রাখবে এই ১২ ডিসেম্বরে সেখানে যা ঘটল, তার জন্য। এদিন লাখো মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জোরদার ও উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি নেওয়ার দাবিতে রাস্তাঘাট দখল করে নিয়েছিল।
এটাই সেই দিন, যেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মত-পথ ও পেশার মানুষ পৃথিবীকে রক্ষার দায়ভার তথাকথিত নেতাদের হাত থেকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। আজ জলবায়ু সম্মেলনের শেষ দিনে আমাদের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা যে ‘চুক্তি’ বা ‘বিধিবিধান’-ই প্রণয়ন করুন না কেন, ইতিহাসের লিখন যারা লিখছে, তারা হলো সেই বিশ্বজনতা। যেসব নেতা দেয়ালে দেয়ালে লেখা ইতিহাসের সেই লিখন পড়তে পারবেন, তাঁরা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আর যাঁরা সেই লিখন উপেক্ষা করবেন, ইতিহাসের ঢেউ তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গত শনিবারই ছিল সেই দিন, যেদিন বিশ্বের বিরাট একটি অংশের মানুষ সত্যিকার একটি বৈশ্বিক হুমকির বিরুদ্ধে একযোগে উঠে দাঁড়িয়েছিল। যদিও আজ হয়তো হতাশ হতে হবে (গত সপ্তাহের রাজনৈতিক কূটকচাল সত্ত্বেও আমি কিছুটা আশাবাদী, খুবই দুর্বল একটি চুক্তি হয়তো হবে), কিন্তু এরই মধ্যে ইতিহাসের স্রোত খাত বদলে ফেলেছে। একে আর ফেরানো যাবে না।
আজ আমরা যা-ই অর্জন করি না কেন, আমরা এক অপরিবর্তনীয় পথে যাত্রা শুরু করেছি। এই বুঝ যাঁরা বুঝছেন, তাঁরা আসবেন জনগণের সব থেকে কম প্রত্যাশিত অংশ থেকে। যাঁদের চোখ খোলা আছে, তাঁদের জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ধরুন, ক্ষুদ্র দ্বীপ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের কথা। তাঁরাই আগামী দিনের নেতা।
কয়েক মাসের মধ্যে জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সত্যিকারের লড়াই চালাতে আমি ফিরে আসব আমার দেশ বাংলাদেশে। আমার লড়াই হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় খারাপ কিংবা দুর্বল নীতির বিরুদ্ধে। আগামী বছরগুলোতে আমার আশা একটাই, পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু উদ্ভাবনাময় ও অদম্য মানুষের দেশ বাংলাদেশ যেন পৃথিবী বিখ্যাত ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পৃথিবীর সব থেকে ‘সক্ষম’ দেশে পরিণত হয়।
আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি বাংলাদেশে নতুন একটি জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার চিন্তা নিয়ে। এর মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি মোকাবিলায় সরকার, নাগরিক সংগঠন, গবেষক, শিক্ষাসম্পর্কিত মানুষজন এবং সাংবাদিকসহ উন্নয়নশীল দেশ থেকে আসা আরও অনেকের সক্ষমতা বাড়ানো ও প্রশিক্ষণের জন্য কাজ করব। এই নতুন প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিকভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা নতুন দুনিয়ায় টিকে থাকার কৌশলের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে এবং চালাবে জ্ঞানের আদান-প্রদান। প্রাথমিকভাবে আমাদের কাজ অনুন্নত দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন বিষয়ে হলেও উন্নত শিল্পায়িত দেশগুলো কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে পারে, সে বিষয়েও পরিকল্পনা তৈরি করছি। পরিহাস এই যে, দুনিয়ার বেশির ভাগ দরিদ্র দেশের মতোই ধনী দেশগুলোও এখনো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরি করেনি।
আমি ফিরছি জলবায়ুর লড়াইয়ের ময়দানের একেবারে সামনের সারিতে, যেখানে এরই মধ্যে মানুষ লড়তে শুরু করেছে। আমি বাংলাদেশে ফিরছি এই আকাঙ্ক্ষা ও আশাবাদী মনোভাব নিয়ে, বিশ্বমানবতা আমাদের সবার জীবনের আশ্রয় এই পৃথিবীকে বিপন্নতা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম। আমি জানি, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আমার এই আশার সহযাত্রী।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত।
সলিমুল হক: লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ক্লাইমেট চেঞ্জ গ্রুপের প্রধান এবং আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্যানেলের (আইপিসিসি) সদস্য।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, তাং ১৮-১২-২০০৯
যাঁরা বলেন, জলবায়ু বদলাচ্ছে না, তাঁদের বেশির ভাগই বিভিন্নভাবে পরিবেশদূষণকারী কলকারখানার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের সঙ্গে আমি মৌখিকভাবে বহু তর্ক করেছি। জীবনে তাঁরা সেসব গ্রামীণ বা শহুরে বসতিগুলোতে পা রাখেননি, যেখানে এরই মধ্যে জলবায়ু বিপর্যয়ের ছাপ ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এসব জায়গায় এলে তাঁরা হয়তো বুঝতে পারতেন, যেসব মানুষ এই বৈশ্বিক হুমকি সৃষ্টির জন্য বিন্দুমাত্রও দায়ী নয়, তাদের কী রকম খেসারত দিতে হচ্ছে। এর জন্য দায়ী ওই সব অস্বীকারকারী মানুষের চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপ।
জলবায়ু সম্মেলন চলতে থাকা কোপেনহেগেনের এই ডিসেম্বরে, আমরা আমাদের চরম বিন্দুতে পৌঁছে গেছি। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, আগামী সময় কোপেনহেগেনকে মনে রাখবে। তবে তা ১৮ ডিসেম্বর সেখানে বিশ্বনেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের জন্য নয়, মনে রাখবে এই ১২ ডিসেম্বরে সেখানে যা ঘটল, তার জন্য। এদিন লাখো মানুষ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জোরদার ও উচ্চাভিলাষী কর্মসূচি নেওয়ার দাবিতে রাস্তাঘাট দখল করে নিয়েছিল।
এটাই সেই দিন, যেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মত-পথ ও পেশার মানুষ পৃথিবীকে রক্ষার দায়ভার তথাকথিত নেতাদের হাত থেকে নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। আজ জলবায়ু সম্মেলনের শেষ দিনে আমাদের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা যে ‘চুক্তি’ বা ‘বিধিবিধান’-ই প্রণয়ন করুন না কেন, ইতিহাসের লিখন যারা লিখছে, তারা হলো সেই বিশ্বজনতা। যেসব নেতা দেয়ালে দেয়ালে লেখা ইতিহাসের সেই লিখন পড়তে পারবেন, তাঁরা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আর যাঁরা সেই লিখন উপেক্ষা করবেন, ইতিহাসের ঢেউ তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। গত শনিবারই ছিল সেই দিন, যেদিন বিশ্বের বিরাট একটি অংশের মানুষ সত্যিকার একটি বৈশ্বিক হুমকির বিরুদ্ধে একযোগে উঠে দাঁড়িয়েছিল। যদিও আজ হয়তো হতাশ হতে হবে (গত সপ্তাহের রাজনৈতিক কূটকচাল সত্ত্বেও আমি কিছুটা আশাবাদী, খুবই দুর্বল একটি চুক্তি হয়তো হবে), কিন্তু এরই মধ্যে ইতিহাসের স্রোত খাত বদলে ফেলেছে। একে আর ফেরানো যাবে না।
আজ আমরা যা-ই অর্জন করি না কেন, আমরা এক অপরিবর্তনীয় পথে যাত্রা শুরু করেছি। এই বুঝ যাঁরা বুঝছেন, তাঁরা আসবেন জনগণের সব থেকে কম প্রত্যাশিত অংশ থেকে। যাঁদের চোখ খোলা আছে, তাঁদের জন্য একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ধরুন, ক্ষুদ্র দ্বীপ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের কথা। তাঁরাই আগামী দিনের নেতা।
কয়েক মাসের মধ্যে জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সত্যিকারের লড়াই চালাতে আমি ফিরে আসব আমার দেশ বাংলাদেশে। আমার লড়াই হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় খারাপ কিংবা দুর্বল নীতির বিরুদ্ধে। আগামী বছরগুলোতে আমার আশা একটাই, পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু উদ্ভাবনাময় ও অদম্য মানুষের দেশ বাংলাদেশ যেন পৃথিবী বিখ্যাত ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পৃথিবীর সব থেকে ‘সক্ষম’ দেশে পরিণত হয়।
আমি দেশে ফিরে যাচ্ছি বাংলাদেশে নতুন একটি জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠার চিন্তা নিয়ে। এর মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি মোকাবিলায় সরকার, নাগরিক সংগঠন, গবেষক, শিক্ষাসম্পর্কিত মানুষজন এবং সাংবাদিকসহ উন্নয়নশীল দেশ থেকে আসা আরও অনেকের সক্ষমতা বাড়ানো ও প্রশিক্ষণের জন্য কাজ করব। এই নতুন প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিকভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা নতুন দুনিয়ায় টিকে থাকার কৌশলের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবে এবং চালাবে জ্ঞানের আদান-প্রদান। প্রাথমিকভাবে আমাদের কাজ অনুন্নত দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন বিষয়ে হলেও উন্নত শিল্পায়িত দেশগুলো কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে পারে, সে বিষয়েও পরিকল্পনা তৈরি করছি। পরিহাস এই যে, দুনিয়ার বেশির ভাগ দরিদ্র দেশের মতোই ধনী দেশগুলোও এখনো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরি করেনি।
আমি ফিরছি জলবায়ুর লড়াইয়ের ময়দানের একেবারে সামনের সারিতে, যেখানে এরই মধ্যে মানুষ লড়তে শুরু করেছে। আমি বাংলাদেশে ফিরছি এই আকাঙ্ক্ষা ও আশাবাদী মনোভাব নিয়ে, বিশ্বমানবতা আমাদের সবার জীবনের আশ্রয় এই পৃথিবীকে বিপন্নতা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম। আমি জানি, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আমার এই আশার সহযাত্রী।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত।
সলিমুল হক: লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ক্লাইমেট চেঞ্জ গ্রুপের প্রধান এবং আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্যানেলের (আইপিসিসি) সদস্য।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, তাং ১৮-১২-২০০৯
No comments:
Post a Comment