Friday, February 12, 2010

বাংলাদেশ বাঁচলেই বিশ্ব বাঁচবে

জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ও মাত্রা হয়তো সবচেয়ে নমনীয় ভবিষ্যদ্বাণীকেও ছাপিয়ে গেছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ও আইপিসিসি

‘পাগল’ প্রকৃতি

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার খোলপেটুয়া নদীপাড়ের আশাশুনি উপজেলা। কৃষক আফরোজের ঘুম সেদিন আগেই ভেঙে যায়। প্রতিবেশীদের সাড়া-শব্দে ঘুম ভেঙে দেখেন পাউবোর বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলের জমি, চিংড়ি ঘের ও বসতভিটা। জোয়ারের পানিতে থই থই করছে ঘর। এমনটি তাঁর জীবনে এই প্রথম।
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বন্যাতলা গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী শামসুর রহমান বলেন, ‘আগে জোয়ারের পানি গ্রামের শেষ সীমানা পর্যন্ত আসত। কিন্তু গত কয়েক বছর নদী যেন পাগল হইয়া গেছে।’ তাঁরা হয়তো জানেন না, প্রকৃতির সন্তান মানুষই প্রকৃতিকে ‘পাগল’ করেছে। তাঁরা এখনো হয়তো জানতে পারেননি যে, সাড়ে তিন মাস পরেই নদী নয়, গোটা সমুদ্রই ‘পাগল হইয়া’ সিডরের বেশে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর সিডরের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আসবে ‘আইলা’। তাঁরা হয়তো এখনো জানেন না, তাঁদের পায়ের তলার মাটি এই যে গেল, সহসা আর তা ফিরবে না। এটা শেষ নয়, শেষের শুরু।
ঠিক একই আতঙ্কে পড়েছেন আমাদের ভোলা আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ ফিজির মানুষেরা। এই মানুষেরা কেউ কাউকে চেনে না। অথচ অজান্তেই তাদের সবার ভাগ্য এক ফাঁসে গাঁথা হয়ে গেছে। সেই ফাঁসের নাম জলবায়ু পরিবর্তন।


আসামি ‘মানুষ ও তার সভ্যতা’
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে যখন সিডর আমাদের উপকূল তছনছ করছে, ঠিক সে সময় স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থা আইপিসিসি তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করছিল। ৬টি মহাদেশের ২০০ জন বিশেষজ্ঞের চার বছরের গবেষণার ফসল ওই প্রতিবেদন। তাতে ঘোষিত হয়, মানবজাতির ইতিহাসের সব থেকে বড় বিপদ হলো জলবায়ু পরিবর্তন আর তার জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশের অতিমাত্রায় জ্বালানি ব্যবহার। পরিহাসটা কেমন, যে বিজ্ঞানের জোরে মানুষ প্রকৃতির রাজা হয়েছে, সেই প্রকৃতির বিচারের রায় লিখিত হলো বিজ্ঞানীদেরই হাতে। সেই রায়ে ঐকমত্যের আসামি হলো ‘মানুষ ও তার সভ্যতা’।
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, তাপেরও ইতিহাস। ১০ হাজার বছর আগে পৃথিবী শীতঘুম ভেঙে উষ্ণ হয়ে ওঠে। সেটাই ছিল মানবসভ্যতার শুরুর সোনালি গ্রীষ্ম। সেই পরিবেশে কৃষিকাজ থেকে শুরু করে সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গত ৩০০ বছরে সেই ‘সভ্য’ মানুষ পৃথিবীর ওপর অনেক অত্যাচার চালিয়েছে। গত ১০ হাজার বছরে প্রাকৃতিকভাবে যত কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরিত হয়েছে, শিল্পবিপ্লবের পরের ৩০০ বছরে জমেছে তার দ্বিগুণ। এর মধ্যে বিশুদ্ধ পানির অর্ধেকটাই ব্যবহূত হয়ে গেছে, মৌসুমী অঞ্চলের প্রাণপ্রজাতির বিলুপ্তির হার বেড়েছে ১০ হাজার গুণ! এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী মানবজাতির বসবাসের অনুপযুক্ত হতে ১০০ বছরও প্রয়োজন হবে না।

কেউ কথা রাখছে না

জ্বালানিখেকো এই সভ্যতার নায়ক যেহেতু উন্নত শিল্পভিত্তিক দেশ, সেহেতু দায়ও তাদের—শাস্তিও তাদেরই পাওনা। পাশ্চাত্যের কোনো নাগরিক প্রতিদিন যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করেন, তার ১০০ ভাগের একভাগও আমাদের মানুষেরা করে না। আমেরিকা কার্বন নিঃসরণ কমানোয় কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করেনি। নতুন কোনো আশাও তারা দিচ্ছে না। উপরন্তু ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ অর্ধেক কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়েছিল, ওবামার সঙ্গে বৈঠকের পর সে লক্ষ্যমাত্রা থেকে সরে এল আসিয়ান ও অ্যাপেক নেতারা। অন্যতম পরিবেশ ধ্বংসকারী দেশ অস্ট্রেলিয়া তাদের নাগরিকদের মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করেছে উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের থেকে ১৫ গুণ বেশি হারে। তাঁরা দেখছেন ব্যবসা, কিন্তু আমরা দেখছি আমাদের মতো ২০০ কোটি মানুষের জীবন। ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ তত্ত্বের জনক উইলিয়াম হান্টিংটন একবার বলেছিলেন, পরিবেশবিধ্বংসী কলকারাখানাগুলো তৃতীয় দুনিয়ায় সরিয়ে দেওয়া উচিত। কারণ, গরিব দেশের মানুষের জীবনের দাম কম। কেন কম? কারণ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নাগরিকদের জন্য সরকারের মাথাপিছু ব্যয় থেকে আমাদের নাগরিকদের মাথাপিছু ব্যয় অনেক কম।
জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরণের উপায় ও তার দায় নিয়ে বিভক্ত বিশ্ব বিভক্তই রয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বাধ্যতামূলকভাবে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে এখনো নারাজ। ইউরোপ তার জনমতের চাপে কিছুটা দায়িত্বশীল। কিন্তু ভারত-চীন-ব্রাজিল ও রাশিয়ার মতো হবু শিল্পোন্নত দেশগুলোর হিসাব-নিকাশ আলাদা। হবুদের যুক্তি তোমরা ৩০০ বছর ইচ্ছামতো কার্বন পুড়িয়ে উন্নত হয়েছ, আমাদের অন্তত ৩০ বছর সময় দাও; ‘কাবু’ থেকে ‘বাবু’ হয়ে নিই। ইউরোপ সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে উন্নতপ্রযুক্তির জোরে যতটা আত্মবিশ্বাসী, ভারত-চীন তাদের বঞ্চনা নিয়ে ততটাই সজাগ। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো ডুবন্ত দেশ আওয়াজ দিচ্ছে, আমাদের ক্ষতিপূরণ দাও, প্রযুক্তি দাও। এই ত্রিপক্ষীয় টানাটানির মীমাংসা ডিসেম্বরের কোপেনহেগেন সম্মেলনে হচ্ছে বলে মনে হয় না।

২০৫০ সাল: সংকট যখন রাজনৈতিক

সমস্যাটা কেবল পরিবেশের বলে ভাবা ভুল। প্রাকৃতিক হলেও পরিণামে তা সার্বিক রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিতে বাধ্য। বিশ্বের প্রতি ৪৫ জনের মধ্যে একজন এবং বাংলাদেশের প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার হবে। একদিকে সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটার বাড়লেই দেশের ১৭ দশমিক পাঁচ থেকে ২০ শতাংশ এলাকা ডুবিয়ে দেবে (সূত্র: ওই)। একদিকে হিমালয়ের বরফ গলা পানি অন্যদিকে সমুদ্রের নোনা প্লাবণে আক্রান্ত হবে আরও বেশি এলাকা। ধানের উত্পাদন কমে যাবে ১০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি লোক সরাসরি জলবায়ু-উদ্বাস্তু হবে। খাদ্য-নিরাপত্তা ও বাসস্থান এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে আরও বেশি মানুষ। এত মানুষের উপায় দেশের ভেতর থেকে করা সম্ভব নয়। যাওয়ার কোনো পথও থাকবে না। আগামী ২০ বছরে বর্ধিত জনসংখ্যার হিসাব ধরলে প্রায় ২০ কোটি মানুষ আমাদের সীমানার মধ্যেই বন্দী হয়ে পড়বে। এমনিতেই দেশ জনসংখ্যার ভারে কুঁজো; সম্পদ, জমি এবং সুযোগের চরম টানাটানি। রাষ্ট্র-প্রশাসন ও রাজনীতি অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও জনস্বার্থবর্জিত। ২০৫০ সাল নাগাদ, যখন সবদিকেই আকাশ ভেঙে পড়বে আর সমুদ্র করবে তোলপাড়, তখন সীমিত সুযোগ নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হবে। যাদের নেই তারা যাদের আছে তাদের ওপর হামলে পড়বে। এই চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে লতিয়ে লতিয়ে বাড়বে রাজনৈতিক হানাহানি, সন্ত্রাস ও দাঙ্গা। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকেও তা উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। পরিবেশের সমস্যা যখন অস্তিত্বের সংকট হয়ে দাঁড়াবে তখন এ দেশ সোমালিয়া বা সুদানের দশা যে পাবে না তার গ্যারান্টি কী?

বাংলাদেশ বাঁচলেই বিশ্ব বাঁচবে


পৃথিবীর জনসংখ্যার দুই দশমিক পাঁচ শতাংশের বাস বাংলাদেশে। অথচ মোট কার্বন নিঃসরণের মাত্র দশমিক এক শতাংশ আমাদের। আমেরিকার জনসংখ্যা বিশ্বের পাঁচ শতাংশ হলেও, তাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২৫ শতাংশ। একেই বলে জলবায়ু-অবিচার। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আমাদের দায় সবচেয়ে কম হয়েও আমরাই হচ্ছি সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের উচিত, এই জলবায়ু অবিচারের বিষয়টি তুলে ধরে জলবায়ু-সুবিচারের দাবি তোলা। ক্ষতিগ্রস্ততম দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করার সুযোগও শেখ হাসিনার জন্য খোলা। কোপেনহেগেনে তাঁর স্লোগান হতে পারে, ‘বাংলাদেশ বাঁচলেই বিশ্ব বাঁচবে।’ বাংলাদেশ যেহেতু সবচেয়ে বিপন্ন, সেহেতু বাংলাদেশ রক্ষা পাওয়া মানে অন্যরাও রক্ষা পাওয়া। তাঁকে জানাতে হবে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা আগের অবস্থায় আনাই বাংলাদেশের অস্তিত্বের শর্ত। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপ যদি তাদের জ্বালানি ব্যবহারের ধরন পাল্টায়, তাহলে আমরা রক্ষা পাব। এ জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলার বৈশ্বিক মডেল ঘোষণা করে, আন্তর্জাতিক তহবিল, জ্ঞানভাণ্ডার, বিশেষজ্ঞ-জমায়েতসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি ও অন্য সব সহায়তা আমাদের দিতে হবে, যাতে আমাদের মানুষগুলোকে, আমাদের কৃষি, নদী, বন, জলাশয় ও প্রাণ-প্রকৃতিকে আমরা বাঁচাতে পারি। এভাবে নতুন যুগের প্রকৃতি-বান্ধব অর্থনীতি, জীবনধারা ও রাজনীতির গোড়াপত্তন হতে পারে বাংলাদেশেই। বাংলাদেশ পথ দেখাতে পারে আর সবাইকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিন বদল ভালোবাসেন। কিন্তু যখন জলবায়ুই বদলে যাচ্ছে, তখন সেই ডাককে অর্থপূর্ণ করার একমাত্র পথ হলো জলবায়ুকে বদলাতে না দেওয়া।

কে শ্রেষ্ঠ, মানুষ না ইঁদুর?

সিডর-আইলার ক্ষতিগ্রস্তরা জানে না, তারা কীসের মার খেল। আমরা পানির দেশের লোক নদীর বন্যা বুঝি, কিন্তু সমুদ্রের ঢল বুঝি না। আমরা একার বিপদ বুঝি কিন্তু সবার বিপদ বুঝি না। বড় সমস্যা হিসেবে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ চিহ্নিত আছে। কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয় যে আখেরে এ প্রবণতাকে শতগুণে বাড়াবে সেই হুঁশ আনছি না। আমরা বড়জোর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার চিন্তা করি, অথচ জলবায়ুর বিপদ মোকাবিলায় প্রয়োজন কমপক্ষে ৫০ বছরের পরিকল্পনা।
দুর্গত উপকূলীয় এলাকার মানুষ এতশত বোঝে না। তাদের একটি ছবি ছাপা হয়েছে ১৭ নভেম্বরের প্রথম আলোয়: আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাঁশের সাঁকো ধরে ঘরবাড়ি-সংসারহারা মানুষেরা বেরিয়ে আসছে। দুই বছর আগে তারা ভাবেনি, ২০০৯ সালের শেষাশেষি তাদের সম্পূর্ণ জলবাসী হয়ে বাঁধে-ভেলায়-ঘরবাড়ির ছাদে আর আশ্রয়কেন্দ্রে পশুর পালের মতো জীবন কাটাতে হবে। উপকূলীয় দুর্গত এলাকায় এখন খাবারের অভাব, পানির অভাব, থাকার জায়গার অভাবসহ যতরকম প্রয়োজন মানুষের হয় সবকিছুরই অভাব। এতসব অভাবের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নিত্যনতুন রোগ, দেখা দিচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও অজানা ভয়। লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিও-বেইজিং-দিল্লি-কোপেনহেগেনের খবর তারা রাখে না। তারা কেবল চায়, পুরোনো ঘরবাড়ি আবার উঠুক, নোনা পানি নেমে যাক, জমিজমা-পরিবার নিয়ে আবার জীবন শুরু হোক। কেবল তাহলেই বাংলাদেশ বাঁচবে, বাঁচবে পৃথিবী। কোপেনহেগেনে এই কথাই তথ্যপ্রমাণ দিয়ে জোরের সঙ্গে বলতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে।
কাতরাতে কাতরাতে পথ হাতড়ানোর আর সুযোগ নেই। ভূমিকম্প বা বন্যার আলামতে ইঁদুর গর্ত ছেড়ে বের হয়, আর এক কাকের বিপদে জড় হয় হাজারো কাক। তারা হয়তো আমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ জীব, তাই তারা পারে— আমরা পারি না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক। 

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, তাং ০৪-১২-২০০৯

No comments:

Post a Comment