Saturday, February 13, 2010

মেঘনার ভাঙ্গনে ঘরছাড়া লক্ষ মানুষ

banner image

মেঘনার নদী গ্রাস করছে বহু মানুষের ভিটেমাটি৻
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্তাপ বাড়ছে, সমুদ্র ক্রমশ স্ফীত এবং উত্তাল হচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞরা এখন এই প্রবণতা নিশ্চিত করছেন, এবং বলছেন এর প্রভাবে বাড়ছে নদী ভাঙ্গন৷ নদী পাড়ের মানুষ কতটা টের পাচেছন তা?
যাত্রা শুরু নোয়াখালী উপকূলের চেয়ারম্যান ঘাট থেকে৷ গন্তব্য হাতিয়া, তারপর চর আলেক্সান্দার, চর মানপুরা অর্থাৎ মেঘনার মোহনা ধরে ধরে ভোলার চর ফ্যাশন৷
তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে সি-ট্রাক নিয়ে নোয়াখালী আর হাতিয়ার মধ্যে মেঘনার মোহনা পাড়ি দিচ্ছেন সারেং আব্দুল মালেক৷ মেঘনাকে তিনি হাড়ে মজ্জায় চেনেন৻
“এই নদীতে আমার বারোটা বাড়ী ভেঙ্গেছে, এখন তের নম্বর বাড়ী চলছে৻`` মেঘনাকে তিনি ৩৩ বছর ধরে দেখছেন৻ আব্দুল মালেক জানালেন, “এই যে চরে আমরা এখন জাহাজ চালাই, এই বিশাল জায়গা, এর উপরে একসময় আমরা জাহাজ চালিয়েছি৻ এখন এটা ভরে গেছে, চর জেগেছে, সেখানে মানুষ বসবাস করছে৻ এরই উপর দিয়ে একসময় আমরা জাহাজ চালিয়েছি৻
‘‘যেখান থেকে আপনি সি ট্রাকে উঠেছেন, সেখানে তো নদী ছিল একসময়৻ সেখানে এখন বিল্ডিং, বিশ হাজার মানুষের বাসবাস৻`` আব্দুল মালেক বলেন৻
পরদিন হাতিয়া থেকে ভোলার পথে চর মানপুরার ঘাটে লঞ্চ ভিড়লে বোঝা গেল এবছর মানপুরা প্রচন্ড ভেঙ্গেছে বলে যে কথা শোনা যাচ্ছিল সেটা মিথ্যে নয়৷ এই নভেম্বরেও গোড়াসহ বড় বড় নারকেল গাছ নদীর ভেতর নোয়ানো৷ সবে ভাঙ্গা বড় বড় মাটির চাঙর৷
erosion
ভাঙ্গনে কবলে হাতিয়া
এম.ভি. টিপুর সারেং মো: নোমান মাস্টারকে অবশ্য অতটা উদ্বিগ্ন শোনালো না৷ তিনি বললেন নদী এদিকে ভাঙলেও পশ্চিমে চর পড়ছে৻ কিন্তু ভাঙ্গনের তীব্রতা কী আগের তুলনায় বাড়ছে?
নোমান মাস্টার বললেন, কোন কোন বছর বেশী ভাঙ্গে, কোন কোন বছর কম৻ মেঘনার একদিকে ভাঙ্গছে, অন্যদিকে পলি পড়ছে৻ তবে এ বছরে পশ্চিমদিকে পলি বেশী পড়ছে৻
‘‘গত দুইবছর আগে কালীগঞ্জের মল্লিকপুরে মেহদীগঞ্জ থানায় প্রচন্ড ভাবে ভেঙ্গেছে৻ যে ভাঙ্গনটা ছিল কল্পনার অতীত৻ আমরা একদিন দেখে গেছি দোকানপাট, রাস্তাঘাট স্কুল কলেজ সবই রয়েছে, পরদিনই এসে দেখি সেগুলো নেই৻ কিন্তু এবছর সেরকম হয়নি৻`` তিনি জানালেন৻
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অধিকাংশই বলছেন মেঘনার মোহনায় ভাঙ্গা গড়ার খেলা অব্যাহত থাকলেও ভাঙ্গনের পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে৷ 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষনা করছেন ড আহসান উদ্দিন আহমেদ৻ তিনি বললেন, এখন মেঘনার অববাহিকায় আগের তুলনায় সমুদ্র পৃষ্ঠ অনেক গরম, এর পক্ষে সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে বলে মি. আহমেদ বললেন, ‘‘স্যাটেলাইটে তোলা তথ্য একাধিক্রমে বছরের পর বছর বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি গত চারদশকে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে৻ সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠবার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৻ জুন এক তারিখ থেকে নভেম্বরের পনের তারিখ পর্যন্ত সময়কালে এরকম ঘটছে৻``
‘‘এর সাথে সমুদ্রসীমার উচ্চতা বেড়ে থাকে, যেটা ভারত মহাসাগরের অন্য জায়গায়ও হয়েছে, তাহলে তার একটা ব্যাকওয়াটার প্রভাব উজানের দিকে ধেয়ে যায়, বিশেষ করে প্রবল বর্ষা মৌশুমে৻ ফলে ভাঙ্গন আগে থাকলেও, এর প্রবণতা এখন কোন কোন জায়গায় অনেক বেশী৻``
ভোলার চর ফ্যাশনের আসলামপুর ইউনিয়ন৷ মেঘনা নদীকে এখানে সাগরের মত মনে হয়৷ স্থানীয় মানুষজন বললেন বছর দুয়েক ধরে ভাঙ্গন তীব্র হয়েছে৷ মূল বেড়িবাঁধ ভাঙ্গার পর বিকল্প বাধটিও চরম হুমকির মুখে৷
আসলামপুরের আয়েশাবাগ গ্রামের লোকজন বললেন মেঘনা যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে এ গ্রামের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা৷
jamila bibi
আবার ভাঙ্গবে জমিলা বিবির ঘর
প্রখমে বাপ দাদার, এরপর শ্বশুরের ভিটে বাড়ী নদীগর্ভে যাওয়ার পর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থেকে বছর বিশেক আগে স্বামীর সাথে এ গ্রামে এসে বসতি গড়েছিলেন জমিলা বিবি৻
তিনি বললেন, নদী একসময় অনেক দূরে ছিল৻ অনেক দূর থেকে দেখা যেত৻ তবে বছরে বছরে এতো কাছে আসেনি৻ তিন বা চার বছর থেকে ভাঙ্গন অনেক বেশী হচ্ছে৻
এখন নদী যেভাবে ভাঙ্গছে, তাতে আগামী দু তিন বছরে কি এই বাড়ী আর থাকবে? এই প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন, এই বাড়ীযে শেষ পর্যন্ত থাকবে না, তা তিনি ভাল করেই জানেন৻ বাড়ী বঙিলে কোথোয় যাবেন, এই প্রশ্নের পর তাঁর জবাব, “আল্লা যেখানে নিয়ে যায়!``
উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় এনজিও কোস্ট৻ এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বললেন. ২০০০ সালে ভোলার ভাঙ্গনের হার হিসাব করে দেখা গেছে আগামী সত্তর বছরের মধ্যে এই জেলা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে৻
তিনি জানান, ২০০৭ সালে বর্ষা মৌশুমে ভোলা খেয়াঘাট যেখান থেকে লঞ্চগুলো ছাড়ে এবং ঢাকার সদরঘাটে লোক বসিয়ে গবেষণা করে জানা গেছে শুধুমাত্র ঐ ছয় মাসে ভাঙ্গনের ফলে চৌদ্দ হাজার পরিবার ভোলা ছেড়ে স্থায়ীভাবে অন্যত্র চলে এসেছে৻

তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলার সৌজন্যে

No comments:

Post a Comment