বিশ্বপরিসরে ২০০৯ সালের সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলোর অন্যতম বছর শেষে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। ইউরোপের বাড়াবাড়ি শীতে এবারের অতি উত্সাহের কোপেনহেগেনের ব্যর্থ শীর্ষ সম্মেলনের উত্তাপ দ্রুতই মিলিয়ে গেল।
উষ্ণ হয়ে ওঠা পৃথিবীতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় অসহায়ত্বে পড়া দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রচেষ্টায় বিশ্বসভায় বাংলাদেশের বিপন্নতা ভালোভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ জলবায়ুর দুর্যোগে সবচেয়ে বিপন্ন শিকার হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃতি পেলেও তা শুকনো সহানুভূতির মালা ছাড়া সামান্যই পেয়েছে। দেশের ভেতর বৈরী রাজনীতির সংস্কৃতিতে পরস্পরকে জলবায়ু সম্মেলনের অর্জন-ব্যর্থতা নিয়ে দোষারোপ থেমে নেই। কিন্তু এতে জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন ও এর ক্ষতিকর ফলাফল কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, এর সমাধান সামান্যই এগিয়েছে।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যু প্রধানত রাজনীতির উপাদান হয়েই সামনে এসেছে। এখানে পরস্পর সংঘাতমুখর বিভিন্ন স্বার্থ ও গোষ্ঠী এত সহজে সবার জন্য গ্রহণীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারাকে বিস্ময়ের সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং কোপেনহেগেনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা কীভাবে তাদের জন্য তৈরি হওয়া সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করে হাসিমুখে ঘরে ফিরল, তা মনোযোগ দিয়ে দেখা দরকার।
সম্মেলনের ঘোষণার অন্যতম ও বহুল আলোচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ুর উষ্ণায়ন ক্ষতি মোকাবিলায় তহবিল (২০১২ পর্যন্ত ৩০ বিলিয়ন ডলারের ‘ক্লাইমেট এইড ফান্ড’ ও ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠিত হবে বলে কোপেনহেগেন ঘোষণায় বলা হয়েছে) সুনির্দিষ্টভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের সমস্যাগুলো মোকাবিলায় কতটুকু কার্যকর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে তা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জলবায়ু নিয়ে বিশ্বসভায় সংলাপে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই বলছেন যে পরিবর্তিত জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কাঙ্ক্ষিত সহায়তা উল্লিখিত তহবিল থেকে পাওয়া যাবে না। তদুপরি ওই তহবিল গঠন এবং তা পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট কাঠামোর অনুপস্থিতিতে পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক ঘোষণাতেই পর্যবসিত হয় কি না, তাও লক্ষ করার বিষয়।
মাথাপ্রতি দূষণের বিবেচনায় শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও মোট দূষণ নিঃসরণে চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি এখন পৃথিবীর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অর্ধেকের দায়ভার বইছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত বিশ্বের অর্থনীতি আবার চীন, ভারত, ব্রাজিলের বাজারের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। স্বভাবতই সম্মেলনের ঘোষণায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেষ্টা ছিল এদের খুশি করা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘ক্লাইমেন্ট এইড ফান্ডের’ সিংহভাগ এই দেশগুলোর দিকে ধাবিত হবে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম (বন উজাড়ের পরিবেশগত ক্ষতি হিসেবে নিলে) গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী ইন্দোনেশিয়াও এর একটি বড় ভাগ পাবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং ‘ক্লাইমেট ভিকটিম’ বা জলবায়ুর উষ্ণায়নের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক শিকার হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আনন্দ আমাদের যত কম সময় পুলকিত রাখবে, বাস্তবতা বিশ্লেষণে ও করণীয় নির্ধারণে তত বেশি মনোযোগী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া আমরা পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে বিপন্ন শিকার, দেশের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ ভূমি দ্রুত ফুঁসে ওঠা সমুদ্রজলে তলিয়ে যাবে বলে হাহুতাশ, পরিবেশ-শরণার্থীর চাপ সামাজিক সংকট অস্থিরতা বাড়াবে বলে আতঙ্কিত আলাপ বেশি করার ক্ষতির দিকটিও ভাবা দরকার।
বহু কষ্টে আমরা সাহায্য ও অনুদান-নির্ভরতার অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পথ ধরেছি। এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ ও সম্ভাবনা দক্ষভাবে তুলে ধরা অতিপ্রয়োজনীয়। অর্থনীতি যদি বহুমুখী হয়, বিনিয়োগের ঝুঁকি সওয়ার মতো সামর্থ্য হয়, তাহলে দেশের মুখ উজ্জ্বলতর হবে, সামাজিক অস্থিরতা হ্রাস পাবে, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বৈরী পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের বাস্তবতায় প্রয়োগযোগ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও এর প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমরা যদি আমাদের অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনাকে ধারাবাহিক উন্নতির উদাহরণ হিসেবে সামনে আনতে পারি, তাহলে বিশ্বপরিসরে আমাদের মর্যাদা দিয়েই সংলাপ-বৈঠকে সমাদর করা হবে। আমাদের যৌক্তিক কথাগুলো মনোযোগ দিয়েই শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
মনে রাখা ভালো, বিশ্বে উষ্ণায়নের কারণগুলো আমাদের সৃষ্ট নয় এবং প্রশমনেও আমরা সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারব। আবহাওয়ামণ্ডলীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ৩৫০ পিপিএমের বেশি হলে মেরুসাগর ও পর্বতশৃঙ্গের বরফ গলানোকে অবধারিত করে। এর অনুষঙ্গ হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, সাইক্লোন, উষ্ণমণ্ডলীয় বিভিন্ন রোগবালাই (যেমন ম্যালেরিয়া, পানিবাহিত রোগ) ইত্যাদির প্রকোপ বাড়ায়। সমুদ্র-উপকূলবর্তী ও বিশাল নদ-নদীর অববাহিকা অঞ্চলে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণায়নের সব নেতিবাচক প্রভাবই অমাদের ওপর দ্রুত স্পষ্ট হচ্ছে। ইতিমধ্যে আবহাওয়ামণ্ডলীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ৩৯০ পিপিএমে পৌঁছেছে। সুতরাং বিশ্বের উষ্ণায়ন অবধারিত। এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো সব ঠেকানো সম্ভব নয়। যা সম্ভব, তা হলো উষ্ণায়নের মাত্রা আরও যাতে না বাড়ে তার চেষ্টা ও জলবায়ুর উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে কীভাবে মানিয়ে চলা যায় তার টেকসই ব্যবস্থা করা।
আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের উদিগরণ দৃশ্যমান ভবিষ্যতে সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে শিল্পায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর আয়োজনে (যেমন—বিদ্যুত্ উত্পাদন, যানবাহনসহ বিভিন্ন ইঞ্জিন চালানো), বন উজাড়সহ সবুজ নিধনের সঙ্গে।
২০৩০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় এনার্জির চাহিদা বাড়বে ৪৫ শতাংশ। এর অর্থ অন্তত আরও দুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকৃতির জ্বালানি ব্যবহারকারীর ভার বহন। দুঃসংবাদ হলো, ২০৩০ পর্যন্ত বর্ধিত জ্বালানি চাহিদার ৮০ শতাংশ আসবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। সবচেয়ে আশাবাদী অনুমান বলছে, ২০৩০ পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ কেবল ইচ্ছের বিষয় নয়, এনার্জির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতার সঙ্গে শক্তি উেসর জোগানের ভৌতিক সামর্থ্য, প্রকৌশলগত ও আর্থিক সীমাবদ্ধতারও সম্পর্ক নিবিড়। সুতরাং জীবাশ্ম জ্বালানির বর্ধিত ব্যবহার আবহাওয়ামণ্ডলীতে বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণ হবে।
তাহলে আমরা কি সবকিছু নিয়তির ওপর ছেড়ে দেব? নিশ্চয়ই নয়। শক্তির জোগান পেতে ও সীমিত জ্বালানি উত্স থেকে কার্যকরভাবে বাড়তি শক্তি পেতে এনার্জি ব্যবহারে দক্ষ প্রযুক্তির সন্ধান যেমন চলবে, একইভাবে পরিবর্তিত জলবায়ুর বিশ্বে মানিয়ে চলার নিরলস চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের টেবিলে জলবায়ুর বৈরী পরিবেশে মানিয়ে চলার কৌশল ও তহবিলের জোগান নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন লোনা জলে টেকসই ধান, বৃষ্টি-খরার পরিবর্তিত চক্রে চাষোপযোগী ফসল, প্লাবনভূমিতে বসবাস উপযোগী বাসস্থান তৈরির স্থানীয় কৌশল উদ্ভাবনে আমাদের ভুক্তভোগী মানুষ অনেকটুকুই এগিয়েছে। এ প্রক্রিয়া আরও বেগবান ও টেকসই করতে, উন্নতর প্রযুক্তি গবেষণা ও এর বাস্তবায়নে আরও সম্পদ দরকার। সম্পদ দরকার নতুন বনায়নে, কম দূষণ করে কিন্তু আর্থকারিগরিভাবে কার্যকর উত্পাদন প্রযুক্তি সন্ধানে। আমাদের জনসংখ্যাপীড়িত দেশে সম্পদের জোগান ও প্রযুক্তির সহায়তা পেতে আন্তর্জাতিক পরিসরে সংলাপ-কূটনীতি অব্যাহত রাখতে হবে। জলবায়ু উষ্ণায়নে আমাদের দায় নগণ্য হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলোর সৃষ্ট দূষণে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছি। সুতরাং বিশ্বসভাকে এ ক্ষতির দায় বহনে কেবল নৈতিকভাবে বাধ্য করা নয়, কার্যকর সহায়তা দিতেও শাণিত যুক্তির সংলাপ দরকার।
ব্যর্থ কোপেনহেগেন সম্মেলনের পর বিশ্বসভায় মানুষ হাল ছেড়ে দেয়নি। বরং নতুন উদ্যমে সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে ছয় মাসের মধ্যে জার্মানির বন ও ২০১০ সালের শেষে মেক্সিকো সিটিতে জলবায়ু সম্মেলনে মিলিত হতে। কোপেনহেগেনে যা অর্জন সম্ভব হয়নি, তা অর্জন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশের আরও ক্ষতি সামলে ওঠার কার্যকর পন্থা খুঁজবে সবাই। আমাদের এখনই সময় দীর্ঘ ও জটিল জলবায়ু-কূটনীতির সুনির্দিষ্ট ও কৌশলগত সংলাপের প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। দেশে জলবায়ু পরিবর্তনে মানিয়ে চলার কর্মকৌশল ও করণীয় নিয়ে ইতিমধ্যে একাধিক দলিল তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলন সভায় সেখানকার সুনির্দিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা আদায় তাই তুলনামূলক সহজ হওয়া উচিত। বিশ্ববাস্তবতা এবং আমাদের জন্য প্রকৃত অর্জনের বাস্তব টার্গেট নির্ধারণ করে দরকার পরিবেশ ও অর্থনৈতিক কূটনীতির সংলাপের জন্য চৌকস সংলাপ কুশলী দল।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।
< লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ০৭-০১-২০১০ তারিখে প্রকাশিত >
উষ্ণ হয়ে ওঠা পৃথিবীতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় অসহায়ত্বে পড়া দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রচেষ্টায় বিশ্বসভায় বাংলাদেশের বিপন্নতা ভালোভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ জলবায়ুর দুর্যোগে সবচেয়ে বিপন্ন শিকার হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃতি পেলেও তা শুকনো সহানুভূতির মালা ছাড়া সামান্যই পেয়েছে। দেশের ভেতর বৈরী রাজনীতির সংস্কৃতিতে পরস্পরকে জলবায়ু সম্মেলনের অর্জন-ব্যর্থতা নিয়ে দোষারোপ থেমে নেই। কিন্তু এতে জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন ও এর ক্ষতিকর ফলাফল কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, এর সমাধান সামান্যই এগিয়েছে।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যু প্রধানত রাজনীতির উপাদান হয়েই সামনে এসেছে। এখানে পরস্পর সংঘাতমুখর বিভিন্ন স্বার্থ ও গোষ্ঠী এত সহজে সবার জন্য গ্রহণীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারাকে বিস্ময়ের সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং কোপেনহেগেনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা কীভাবে তাদের জন্য তৈরি হওয়া সংকটকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করে হাসিমুখে ঘরে ফিরল, তা মনোযোগ দিয়ে দেখা দরকার।
সম্মেলনের ঘোষণার অন্যতম ও বহুল আলোচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ৩০ বিলিয়ন ডলারের জলবায়ুর উষ্ণায়ন ক্ষতি মোকাবিলায় তহবিল (২০১২ পর্যন্ত ৩০ বিলিয়ন ডলারের ‘ক্লাইমেট এইড ফান্ড’ ও ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠিত হবে বলে কোপেনহেগেন ঘোষণায় বলা হয়েছে) সুনির্দিষ্টভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের সমস্যাগুলো মোকাবিলায় কতটুকু কার্যকর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে তা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জলবায়ু নিয়ে বিশ্বসভায় সংলাপে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই বলছেন যে পরিবর্তিত জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কাঙ্ক্ষিত সহায়তা উল্লিখিত তহবিল থেকে পাওয়া যাবে না। তদুপরি ওই তহবিল গঠন এবং তা পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট কাঠামোর অনুপস্থিতিতে পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক ঘোষণাতেই পর্যবসিত হয় কি না, তাও লক্ষ করার বিষয়।
মাথাপ্রতি দূষণের বিবেচনায় শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও মোট দূষণ নিঃসরণে চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি এখন পৃথিবীর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অর্ধেকের দায়ভার বইছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ শিল্পোন্নত বিশ্বের অর্থনীতি আবার চীন, ভারত, ব্রাজিলের বাজারের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। স্বভাবতই সম্মেলনের ঘোষণায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেষ্টা ছিল এদের খুশি করা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘ক্লাইমেন্ট এইড ফান্ডের’ সিংহভাগ এই দেশগুলোর দিকে ধাবিত হবে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম (বন উজাড়ের পরিবেশগত ক্ষতি হিসেবে নিলে) গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী ইন্দোনেশিয়াও এর একটি বড় ভাগ পাবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং ‘ক্লাইমেট ভিকটিম’ বা জলবায়ুর উষ্ণায়নের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক শিকার হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আনন্দ আমাদের যত কম সময় পুলকিত রাখবে, বাস্তবতা বিশ্লেষণে ও করণীয় নির্ধারণে তত বেশি মনোযোগী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া আমরা পরিবেশ বিপর্যয়ের সবচেয়ে বিপন্ন শিকার, দেশের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ ভূমি দ্রুত ফুঁসে ওঠা সমুদ্রজলে তলিয়ে যাবে বলে হাহুতাশ, পরিবেশ-শরণার্থীর চাপ সামাজিক সংকট অস্থিরতা বাড়াবে বলে আতঙ্কিত আলাপ বেশি করার ক্ষতির দিকটিও ভাবা দরকার।
বহু কষ্টে আমরা সাহায্য ও অনুদান-নির্ভরতার অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পথ ধরেছি। এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ ও সম্ভাবনা দক্ষভাবে তুলে ধরা অতিপ্রয়োজনীয়। অর্থনীতি যদি বহুমুখী হয়, বিনিয়োগের ঝুঁকি সওয়ার মতো সামর্থ্য হয়, তাহলে দেশের মুখ উজ্জ্বলতর হবে, সামাজিক অস্থিরতা হ্রাস পাবে, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বৈরী পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের বাস্তবতায় প্রয়োগযোগ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও এর প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমরা যদি আমাদের অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনাকে ধারাবাহিক উন্নতির উদাহরণ হিসেবে সামনে আনতে পারি, তাহলে বিশ্বপরিসরে আমাদের মর্যাদা দিয়েই সংলাপ-বৈঠকে সমাদর করা হবে। আমাদের যৌক্তিক কথাগুলো মনোযোগ দিয়েই শোনার আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
মনে রাখা ভালো, বিশ্বে উষ্ণায়নের কারণগুলো আমাদের সৃষ্ট নয় এবং প্রশমনেও আমরা সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারব। আবহাওয়ামণ্ডলীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ৩৫০ পিপিএমের বেশি হলে মেরুসাগর ও পর্বতশৃঙ্গের বরফ গলানোকে অবধারিত করে। এর অনুষঙ্গ হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, সাইক্লোন, উষ্ণমণ্ডলীয় বিভিন্ন রোগবালাই (যেমন ম্যালেরিয়া, পানিবাহিত রোগ) ইত্যাদির প্রকোপ বাড়ায়। সমুদ্র-উপকূলবর্তী ও বিশাল নদ-নদীর অববাহিকা অঞ্চলে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণায়নের সব নেতিবাচক প্রভাবই অমাদের ওপর দ্রুত স্পষ্ট হচ্ছে। ইতিমধ্যে আবহাওয়ামণ্ডলীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ৩৯০ পিপিএমে পৌঁছেছে। সুতরাং বিশ্বের উষ্ণায়ন অবধারিত। এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো সব ঠেকানো সম্ভব নয়। যা সম্ভব, তা হলো উষ্ণায়নের মাত্রা আরও যাতে না বাড়ে তার চেষ্টা ও জলবায়ুর উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে কীভাবে মানিয়ে চলা যায় তার টেকসই ব্যবস্থা করা।
আবহাওয়ামণ্ডলীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন গ্যাসসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের উদিগরণ দৃশ্যমান ভবিষ্যতে সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে শিল্পায়ন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর আয়োজনে (যেমন—বিদ্যুত্ উত্পাদন, যানবাহনসহ বিভিন্ন ইঞ্জিন চালানো), বন উজাড়সহ সবুজ নিধনের সঙ্গে।
২০৩০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় এনার্জির চাহিদা বাড়বে ৪৫ শতাংশ। এর অর্থ অন্তত আরও দুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকৃতির জ্বালানি ব্যবহারকারীর ভার বহন। দুঃসংবাদ হলো, ২০৩০ পর্যন্ত বর্ধিত জ্বালানি চাহিদার ৮০ শতাংশ আসবে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। সবচেয়ে আশাবাদী অনুমান বলছে, ২০৩০ পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ কেবল ইচ্ছের বিষয় নয়, এনার্জির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতার সঙ্গে শক্তি উেসর জোগানের ভৌতিক সামর্থ্য, প্রকৌশলগত ও আর্থিক সীমাবদ্ধতারও সম্পর্ক নিবিড়। সুতরাং জীবাশ্ম জ্বালানির বর্ধিত ব্যবহার আবহাওয়ামণ্ডলীতে বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণ হবে।
তাহলে আমরা কি সবকিছু নিয়তির ওপর ছেড়ে দেব? নিশ্চয়ই নয়। শক্তির জোগান পেতে ও সীমিত জ্বালানি উত্স থেকে কার্যকরভাবে বাড়তি শক্তি পেতে এনার্জি ব্যবহারে দক্ষ প্রযুক্তির সন্ধান যেমন চলবে, একইভাবে পরিবর্তিত জলবায়ুর বিশ্বে মানিয়ে চলার নিরলস চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের টেবিলে জলবায়ুর বৈরী পরিবেশে মানিয়ে চলার কৌশল ও তহবিলের জোগান নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তখন লোনা জলে টেকসই ধান, বৃষ্টি-খরার পরিবর্তিত চক্রে চাষোপযোগী ফসল, প্লাবনভূমিতে বসবাস উপযোগী বাসস্থান তৈরির স্থানীয় কৌশল উদ্ভাবনে আমাদের ভুক্তভোগী মানুষ অনেকটুকুই এগিয়েছে। এ প্রক্রিয়া আরও বেগবান ও টেকসই করতে, উন্নতর প্রযুক্তি গবেষণা ও এর বাস্তবায়নে আরও সম্পদ দরকার। সম্পদ দরকার নতুন বনায়নে, কম দূষণ করে কিন্তু আর্থকারিগরিভাবে কার্যকর উত্পাদন প্রযুক্তি সন্ধানে। আমাদের জনসংখ্যাপীড়িত দেশে সম্পদের জোগান ও প্রযুক্তির সহায়তা পেতে আন্তর্জাতিক পরিসরে সংলাপ-কূটনীতি অব্যাহত রাখতে হবে। জলবায়ু উষ্ণায়নে আমাদের দায় নগণ্য হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলোর সৃষ্ট দূষণে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছি। সুতরাং বিশ্বসভাকে এ ক্ষতির দায় বহনে কেবল নৈতিকভাবে বাধ্য করা নয়, কার্যকর সহায়তা দিতেও শাণিত যুক্তির সংলাপ দরকার।
ব্যর্থ কোপেনহেগেন সম্মেলনের পর বিশ্বসভায় মানুষ হাল ছেড়ে দেয়নি। বরং নতুন উদ্যমে সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে ছয় মাসের মধ্যে জার্মানির বন ও ২০১০ সালের শেষে মেক্সিকো সিটিতে জলবায়ু সম্মেলনে মিলিত হতে। কোপেনহেগেনে যা অর্জন সম্ভব হয়নি, তা অর্জন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশের আরও ক্ষতি সামলে ওঠার কার্যকর পন্থা খুঁজবে সবাই। আমাদের এখনই সময় দীর্ঘ ও জটিল জলবায়ু-কূটনীতির সুনির্দিষ্ট ও কৌশলগত সংলাপের প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। দেশে জলবায়ু পরিবর্তনে মানিয়ে চলার কর্মকৌশল ও করণীয় নিয়ে ইতিমধ্যে একাধিক দলিল তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলন সভায় সেখানকার সুনির্দিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা আদায় তাই তুলনামূলক সহজ হওয়া উচিত। বিশ্ববাস্তবতা এবং আমাদের জন্য প্রকৃত অর্জনের বাস্তব টার্গেট নির্ধারণ করে দরকার পরিবেশ ও অর্থনৈতিক কূটনীতির সংলাপের জন্য চৌকস সংলাপ কুশলী দল।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments:
Post a Comment