বিশ্ববাসীর চোখ এখন কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনের দিকে। কয়েক শ বছর ধরে চলতে থাকা জলবায়ু পরিবর্তন জানান দিতে শুরু করেছে, এর ভয়াবহতা কতটা ব্যাপক হতে পারে।আতঙ্কিত এখন পুরো বিশ্ব, কেননা বিশ্বের জনসংখ্যা এবং প্রতিবেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে, ভবিষ্যতে এর তীব্রতা আরও বাড়বে। এতে দারিদ্র্য বাড়ছে, অবকাঠামো ভেঙে পড়ার দিকে। যুগ যুগ ধরে তৈরি হওয়া উন্নয়নপ্রচেষ্টার প্রতি এটি এক বড় ধরনের হুমকি। সবার ওপরই এর প্রভাব পড়ছে, ভবিষ্যতেও পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার আগেই একে সুস্থিত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে এ সম্মেলনে, বিশ্বের জনগণ এমন আশায় বুক বাঁধছেন। বিশ্বজুড়েই এক বড়সড় আয়োজন চলছে।
কিন্তু সবার কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব একই রকমভাবে অনুভূত হবে না। সবচেয়ে কম সম্পদ আছে যার, সে-ই ভুক্তভোগী হবে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে নারীর ওপরই এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে বেশি। নারীরা আবার দরিদ্রও বটে। সম্প্রতি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গরিব দেশের দরিদ্র নারীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি, যদিও এই পরিবর্তনে তাদের অবদান খুবই কম। দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশনের মতে, বিশ্বের ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন দরিদ্র নারী জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ভুক্তভোগীদের তালিকায় সবচেয়ে সামনের সারিতে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, তা নারীকে আঘাত করে সবচেয়ে বেশি। এ সময় নারীর সংসারের কাজ বেড়ে যায়, তাকে প্রতিকূল পরিবেশে খাদ্য প্রস্তুত, জ্বালানি ও পানি সংগ্রহের জন্য অনেক বেশি সময় দিতে হয়, শ্রম দিতে হয়। মেয়েশিশুদের ঘরের কাজে সহায়তার পরিমাণ বেড়ে যায়, তার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ সময় বাল্যবিবাহের প্রবণতাও বাড়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যস্ততার সময় নারী একদিকে শিশুকে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার চেষ্টা করে, অন্যদিকে গৃহস্থালির জিনিসপত্র রক্ষার চেষ্টা করে। এ কাজগুলো তাদের জন্য খুব কষ্টের হয়। এ কারণেই অনেক নারী মারা যায়। ছোট শিশুরা এ সময় মায়ের কোল থেকে নামতে চায় না; সেই শিশুকে কোলে নিয়েই নারীকে চলতে হয়, ফলে নারী ও শিশু উভয়ে দুরবস্থার শিকার হয়। কোনো কোনো সময় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বাংলাদেশে কোন এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটার (বিশেষ করে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায়) পর গর্ভবতী, দুগ্ধবতী ও বয়স্ক নারীর ক্ষেত্রে এই জলবায়ু পরিবর্তন স্বাস্থ্য-হুমকি বাড়ায়। এ সময় সাধারণত পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কমে যায় এবং গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে। ফলে ফসল কম হবে। তখন নারীর অপুষ্টি দেখা দেবে সবচেয়ে বেশি। কারণটিও স্পষ্ট। বাংলাদেশের মতো পিতৃপ্রধান দেশে পরিবারে খাদ্যের অসম বণ্টন, খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকারেও নারীর প্রবেশাধিকার কম হওয়ায় এবং সামাজিক মতাদর্শের কারণে নারীর জন্য ক্যালরির পরিমাণ কমে যাবে।
বাংলাদেশের চর ও উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকে নারীরা। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সাধারণত কাজের খোঁজে শহরে বা অন্য জায়গায় যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এলে সেখানে থেকে যাওয়া নারীরাই তখন সন্তান আর বয়স্কদের দেখে রাখে। তীব্র সংকটের মুহূর্তেও তারা অসহায় হয়ে না পড়ে চেষ্টা করে প্রতিকূল পরিস্থিতি উতরে যেতে। নারীর এ লড়িয়ে ভূমিকার স্বীকৃতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও উঠে এসেছে। গত মাসে রোমে আয়োজিত খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্বসম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রক্রিয়ায় তিনি নারীকে সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জ্ঞান তাদের আছে; আর তাই জলবায়ু পরিকল্পনাবিষয়ক নীতি, পরিকল্পনা, কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মতো সকল ক্ষেত্রে নারীকে অবশ্যই জড়িত করতে হবে।’ (ইউএনবি, ১৯ নভেম্বর, ২০০৯) আমাদের সরকারপ্রধানের এমন উপলব্ধি নিঃসন্দেহে আশাসঞ্চারী। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীকে বাদ দেওয়া হয়; সমন্বিত দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীর নিজস্ব জ্ঞান কাজে লাগানো হয় না। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সব ক্ষেত্রে নারীকে জড়িত করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও এর প্রভাবকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সব উদ্যোগে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বজুড়েই প্রতিবেশকে বিপর্যস্ত করছে, মানুষকে স্থানান্তর করছে, উদ্বাস্তু করছে, সীমিত সম্পদের ওপর বেড়ে যাচ্ছে অকল্পনীয় প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তৈরি হওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যস্ত এলাকায় বেড়ে যায় নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় নারীকে। বিপর্যয়-পরবর্তী অবস্থায় ঘরে ও শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে নারী-সহিংসতার শিকার হয়।
এর বাইরের চিত্রও আছে, বাংলাদেশের নারীরা এ অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল নেয়। তারা বিপর্যয়ের প্রস্তুতি হিসেবে খাদ্য মজুদ রাখা, জ্বালানি, গৃহপালিত পশুদের খাবার সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা করে। তারা গৃহ পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়াসহ গৃহস্থালির পুনর্ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশ নেয়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ NAPA (National Adaptation Programme of Action) তৈরি করেছে এবং এখন এটি বাস্তবায়নের পথে আছে। এখানে লক্ষণীয় যে নারীকে সব সময় জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হিসেবেই দেখানো হয়েছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনাকে সামনে আনা হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনে নারীর নাজুকতা এত দিন খুব বেশি স্পষ্টভাবে দেখা বা এটিকে রাজনৈতিকভাবে সামনে আনা হয়নি। কারণ, তারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন করার কৌশল জানে এবং কীভাবে এর প্রভাব কম হবে, সেটিও জানে। সংগঠক হিসেবে, নেতা হিসেবে এবং সংসারের দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে নারী জলবায়ু পরিবর্তনের সময় কার্বন ডাই-অক্সাইডের ক্ষতি কমানোর ক্ষেত্রেও সাহায্য করছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নীতিতে নারীর অভিজ্ঞতা, অভিযোজন কৌশল কিংবা প্রভাবের লিঙ্গীয় দিকটি অনুল্লিখিত রয়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনভিত্তিক কৌশলপত্র, অর্থায়ন এবং প্রকল্পে লিঙ্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি অতি জরুরি। এ মাসে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে বিষয়টি সামনে আসা প্রয়োজন।
এ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীর অভিজ্ঞতা ও লিঙ্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর প্রভাব দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বিশাল ঝুঁকিতে থেকে যাবে বিশ্বের বড় অংশের দরিদ্র নারীরা।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, তাং ১৭-১২-২০০৯
কিন্তু সবার কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব একই রকমভাবে অনুভূত হবে না। সবচেয়ে কম সম্পদ আছে যার, সে-ই ভুক্তভোগী হবে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে নারীর ওপরই এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে বেশি। নারীরা আবার দরিদ্রও বটে। সম্প্রতি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গরিব দেশের দরিদ্র নারীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি, যদিও এই পরিবর্তনে তাদের অবদান খুবই কম। দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশনের মতে, বিশ্বের ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন দরিদ্র নারী জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ভুক্তভোগীদের তালিকায় সবচেয়ে সামনের সারিতে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, তা নারীকে আঘাত করে সবচেয়ে বেশি। এ সময় নারীর সংসারের কাজ বেড়ে যায়, তাকে প্রতিকূল পরিবেশে খাদ্য প্রস্তুত, জ্বালানি ও পানি সংগ্রহের জন্য অনেক বেশি সময় দিতে হয়, শ্রম দিতে হয়। মেয়েশিশুদের ঘরের কাজে সহায়তার পরিমাণ বেড়ে যায়, তার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ সময় বাল্যবিবাহের প্রবণতাও বাড়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যস্ততার সময় নারী একদিকে শিশুকে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার চেষ্টা করে, অন্যদিকে গৃহস্থালির জিনিসপত্র রক্ষার চেষ্টা করে। এ কাজগুলো তাদের জন্য খুব কষ্টের হয়। এ কারণেই অনেক নারী মারা যায়। ছোট শিশুরা এ সময় মায়ের কোল থেকে নামতে চায় না; সেই শিশুকে কোলে নিয়েই নারীকে চলতে হয়, ফলে নারী ও শিশু উভয়ে দুরবস্থার শিকার হয়। কোনো কোনো সময় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বাংলাদেশে কোন এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটার (বিশেষ করে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায়) পর গর্ভবতী, দুগ্ধবতী ও বয়স্ক নারীর ক্ষেত্রে এই জলবায়ু পরিবর্তন স্বাস্থ্য-হুমকি বাড়ায়। এ সময় সাধারণত পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কমে যায় এবং গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে। ফলে ফসল কম হবে। তখন নারীর অপুষ্টি দেখা দেবে সবচেয়ে বেশি। কারণটিও স্পষ্ট। বাংলাদেশের মতো পিতৃপ্রধান দেশে পরিবারে খাদ্যের অসম বণ্টন, খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকারেও নারীর প্রবেশাধিকার কম হওয়ায় এবং সামাজিক মতাদর্শের কারণে নারীর জন্য ক্যালরির পরিমাণ কমে যাবে।
বাংলাদেশের চর ও উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকে নারীরা। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সাধারণত কাজের খোঁজে শহরে বা অন্য জায়গায় যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এলে সেখানে থেকে যাওয়া নারীরাই তখন সন্তান আর বয়স্কদের দেখে রাখে। তীব্র সংকটের মুহূর্তেও তারা অসহায় হয়ে না পড়ে চেষ্টা করে প্রতিকূল পরিস্থিতি উতরে যেতে। নারীর এ লড়িয়ে ভূমিকার স্বীকৃতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যেও উঠে এসেছে। গত মাসে রোমে আয়োজিত খাদ্যনিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্বসম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রক্রিয়ায় তিনি নারীকে সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জ্ঞান তাদের আছে; আর তাই জলবায়ু পরিকল্পনাবিষয়ক নীতি, পরিকল্পনা, কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মতো সকল ক্ষেত্রে নারীকে অবশ্যই জড়িত করতে হবে।’ (ইউএনবি, ১৯ নভেম্বর, ২০০৯) আমাদের সরকারপ্রধানের এমন উপলব্ধি নিঃসন্দেহে আশাসঞ্চারী। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীকে বাদ দেওয়া হয়; সমন্বিত দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীর নিজস্ব জ্ঞান কাজে লাগানো হয় না। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সব ক্ষেত্রে নারীকে জড়িত করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও এর প্রভাবকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সব উদ্যোগে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বজুড়েই প্রতিবেশকে বিপর্যস্ত করছে, মানুষকে স্থানান্তর করছে, উদ্বাস্তু করছে, সীমিত সম্পদের ওপর বেড়ে যাচ্ছে অকল্পনীয় প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তৈরি হওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যস্ত এলাকায় বেড়ে যায় নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা। ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় নারীকে। বিপর্যয়-পরবর্তী অবস্থায় ঘরে ও শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে নারী-সহিংসতার শিকার হয়।
এর বাইরের চিত্রও আছে, বাংলাদেশের নারীরা এ অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল নেয়। তারা বিপর্যয়ের প্রস্তুতি হিসেবে খাদ্য মজুদ রাখা, জ্বালানি, গৃহপালিত পশুদের খাবার সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা করে। তারা গৃহ পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়াসহ গৃহস্থালির পুনর্ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশ নেয়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ NAPA (National Adaptation Programme of Action) তৈরি করেছে এবং এখন এটি বাস্তবায়নের পথে আছে। এখানে লক্ষণীয় যে নারীকে সব সময় জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হিসেবেই দেখানো হয়েছে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনাকে সামনে আনা হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনে নারীর নাজুকতা এত দিন খুব বেশি স্পষ্টভাবে দেখা বা এটিকে রাজনৈতিকভাবে সামনে আনা হয়নি। কারণ, তারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন করার কৌশল জানে এবং কীভাবে এর প্রভাব কম হবে, সেটিও জানে। সংগঠক হিসেবে, নেতা হিসেবে এবং সংসারের দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে নারী জলবায়ু পরিবর্তনের সময় কার্বন ডাই-অক্সাইডের ক্ষতি কমানোর ক্ষেত্রেও সাহায্য করছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নীতিতে নারীর অভিজ্ঞতা, অভিযোজন কৌশল কিংবা প্রভাবের লিঙ্গীয় দিকটি অনুল্লিখিত রয়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনভিত্তিক কৌশলপত্র, অর্থায়ন এবং প্রকল্পে লিঙ্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি অতি জরুরি। এ মাসে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে বিষয়টি সামনে আসা প্রয়োজন।
এ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীর অভিজ্ঞতা ও লিঙ্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর প্রভাব দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে বিশাল ঝুঁকিতে থেকে যাবে বিশ্বের বড় অংশের দরিদ্র নারীরা।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments:
Post a Comment