জোয়ার ভাটায় ক্ষতবিক্ষত উপকূল
বাংলাদেশের উপকূলে গত দু বছরে পর পর দুটো ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড় বয়ে গেছে৷ ২০০৭ এর নভেম্বরে সিডর, আর তার ছয়মাসের মাথায় আয়লা৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন এসব ঝড়-জলোচ্ছ্বাস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান একটি উপসর্গ৷ উপর্যূপরি এসব প্রাকৃতিক দূর্যোগ কতটা বিপন্ন করে তুলেছে উপকূলের বাসিন্দাদের ?
কয়রার সবচেয়ে কাছের বড় শহর খুলনা৷ শহরের উপকন্ঠে পতিত এক জমিতে গোলপাতা আর বাঁশের ছাপড়া তুলে গত ছয় মাস ধরে বসবাস করছেন মোসলেম সর্দার৷
মে মাসে আয়লায় ঘরবাড়ী, জমি ডুবে যাওয়ার পর খুলনার সুন্দরবন লাগোয়া কয়রা উপজেলার বাঘালি ইউনিয়নের এই কৃষক বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছেন৷ দু ছেলে রিকশা চালিয়ে যা আয় করে তা দিয়ে দিন চলছে৻
বলছিলেন দুবিঘা জমির ওপর ভিটেবাড়ী ছিল৻ গত ছ মাস ধরে পানির নীচে৻ গরু-ছাগল, জিনিসপত্র বেঁচে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন৻
মোসলেম সর্দার জানালেন তার মত অনেকেই গ্রাম ছেড়েছেন৻ খুলনার যে এলাকায় এসে তিনি উঠেছেন, তার আশেপাশেই কয়রা ছেড়ে আসা আঠারো-কুড়ি পরিবার বসবাস করছে৻
‘অনেকে আত্মীয়দের কাছে গিয়ে আছে৻ আর যাদের আত্মীয়স্বজন নেই, তারা শহরের ফুটপাতে৻ কেউ গেছে সাতক্ষীরা, কেউ যশোর`৻
কিন্তু এখনও যারা ঘর-জমি-জিরাত আঁকড়ে কয়রায় পড়ে আছেন, তারা কেমন দিন কাটাচ্ছেন?
কয়রার একটি মাত্র রাস্তা |
কয়রার উপজেলা সদর থেকে একটি মাত্র রাস্তা দিয়ে এখনও কিছুদূর হাঁটা যায়৻ অবশ্য একটু পর পরই সরু বাঁশের সাকো পেরুতে হয়৻ সাকোর নীচ দিয়ে রাস্তা ভেঙ্গে খাল হয়ে গেছে৻
রাস্তা ধরে যেতে যেতে স্থানীয় সাংবাদিক মতিয়ার রহমান জানালেন, কয়রার দু দিকে দুটো নদী -- শাকবাড়িয়া এবং কপোতাক্ষ৻ আয়লাতে ঐ দুটো নদী মোট ২০ জায়গায় ভেঙ্গে কয়রার মোট সাতটির ভেতর ছটি ইউনিয়নই পুরো তলিয়ে গেছে৻
ঝড়ের ছ মাস পরেও সেই প্লাবন অব্যাহত৷ দিনে দুবার লবণ পানির জোয়ার ভাঁটা হচ্ছে৷ পানিবন্দী হয়ে রয়েছেন কয়রার প্রায় দু লক্ষ মানুষ৻ লোকজন বললেন, রাস্তার দুপাশে দিগন্ত পর্যন্ত যে নোনা পানির জলাশয় দেখা যাচ্ছে, সেগুলো ছ মাস আগেও ছিল ধানের জমি৻
কয়রা উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটারের মধ্যেই ঝিলিয়াঘাটা গ্রাম৻ দেখেই বোঝা যায় সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল৻ আধডোবা বাড়ীঘর ভাঙ্গা দুমড়ানো হলেও, প্রায় প্রতিটি বাড়ীর সামনেই ধানের গোলা চোখে পড়ে৻ চারদিকে নারকেল, সুপারী সহ ফলের গাছ ৻ অবশ্য তাল আর কিছু নারকেল গাছ বাদে সমস্ত গাছ যে শুকিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে সেটা স্পষ্ট৻
ঝিলিয়াঘাটার বটকৃষ্ণ ঢালী আদর্শ কৃষক হিসেবে খুলনা জেলার ভেতরে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলেন বছর কয়েক আগে৻ আয়লার আগে মূল সড়ক থেকে বাড়ী পর্যন্ত ইঁট বিছিয়ে রাস্তা তৈরী করে নিয়েছিলেন ৻ এখন পাঁচঁটি বাঁশ দিয়ে বানানো লম্বা সরু সাঁকো দিয়ে বাড়ীতে ঢুকতে হয় তাকে৻
হাত দিয়ে দেখালেন আশেপাশের ডুবে থাকা জমিগুলো তার৻ রাস্তায় দূরে দেখা গেল আগা মরা ছোট বড় প্রচুর ফলের গাছ৻ পাঁচশ পেয়ারা গাছের বাগান ছিল তার৻ দুশ‘র মত আম গাছ, তিনশ‘র মত কাগজী লেবুর গাছ৻
‘নোনা পানিতে সব শেষ`, বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে গেল বটকৃষ্ণ ঢালীর৻ ‘প্রতিদিন সকালে উঠে গাছগুলোকে না দেখলে শান্তি লাগত না, এখন আর তা পারিনা...কষ্ট হয়`৻
বটকৃষ্ণ ঢালীর গরু ছিল এগারটা৻ আক্ষেপ করে বললেন, ঝড়ের পর গরুগুলো যখন দিনের মত দিন পানি খেতে পারছিল না, পানির দরে বেঁচে দিতে বাধ্য হয়েছেন৻ ‘ভাবলাম ওগুলো তো অন্তত প্রাণে বাঁচুক`৻
একই কাহিনী বটকৃষ্ণ ঢালীর প্রতিবেশীদের, এবং কয়রায় ছটি ইউনিয়নের দেড় থেকে দু লক্ষ মানুষের৷ এক প্রতিবেশীর খালি বাড়ী দেখিয়ে বললেন, এরা বাড়ীঘর ছেড়ে বাগেরহাট শহরে ছেলের কাছে গিয়ে উঠেছেন৻
ঝিলিয়াঘাটার আরেক বাসিন্দা শিবানী |
বটকৃষ্ণের আরেক সম্পন্ন প্রতিবেশী শিবানী বললেন পরপর দু দুটো ধান করতে পারেননি তারা৻ কিভাবে চলবে, কিভাবে থাকবেন ভেবে পাচ্ছেন না৻ চোখে পানি নিয়ে বললেন, ‘হঠাত গরীব হয়ে গেছি`৻
নোনা পানিতে কাহিল হয়ে গেছেন কয়রার মানুষ৻ দুটো ফসল হয়নি৻ আবার কবে হবে জানেন না৻ খাওয়ার পানির কষ্ট সবচেয়ে বেশী৻ পাঁচ দশ মাইল ভেঙ্গে নৌকোয় করে উপজেলা সদর থেকে খাবার পানি আনতে দশ থেকে পঁচিশ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে প্রতিদিন৻
স্থানীয় কপোতাক্ষ কলেজের শিক্ষকরা বললেন আয়লার পর থেকে অর্ধেক ছাত্র ক্লাসে আসছে না৷
কতদিন রাস্তা আর বাঁধের ওপর থাকতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে৻
কতদিন রাস্তা আর বাঁধের ওপর থাকতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে৻
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ৻ তিনি মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে সমুদ্রের উপরিতল স্ফীত হয়ে বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চল ডুবে যাবে, এ ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয়৻
‘আমি বরঞ্চ বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছি`৻ তার মতে, ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা বেড়ী বাঁধগুলো বাড়তি চাপের ঢেউয়ের ধাক্কায় হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, যদি সেগুলো ঠিক করা না হয়৻ সেক্ষেত্রে পানি বাঁধের ভেতরে ঢোকার পর, সেচ করে তা সরিয়ে দেয়া গেলেও, তা রেখে যাবে লবণ৻
‘ফলে প্রতিটি বাঁধের ভেতরে কৃষির জন্য এক একটি মরনফাঁদ তৈরী হবে, যার ভেতরে মানুষ হয়ত থাকতে পারবে, কিন্তু সেখানে কৃষিকাজ করা যাবে না বছরের পর বছর`৻
কয়রার অবস্থাটা এখন সরকমই৻ ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ দেয়ার পর প্রায় লবণমুক্ত হয়ে উঠেছিল সুন্দরবন লাগোয়া কয়রা ৷
ধান, মাছ, সব্জী, ফলমূলে উদ্বৃত্ত হয়ে উঠেছিল এই অঞ্চল৷ কিন্তু একসময়ের উর্বর ধানের জমিগুলো এখন লবণ পানির হ্রদ৷
কয়রার উপজেলা চেয়ারম্যান মহসিন রেজার বা উপজেলা প্রশাসনের খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই কিভাবে, কতদিনে ভাঙ্গা বাঁধের মেরামত হবে, কতদিনে লবণ পানি সরে এলাকায় আবার চাষাবাদ হবে৻
মহসিন রেজা বললেন যে এখন বাঁধ নির্মাণই তাদের সবচেয়ে জরুরী কাজ৻ কারণ পানি না নামলে কিছুই করা যাবে না৻
"মানুষ এমন পরিস্থিতিতে টিঁকে নাও থাকতে পারে" |
কয়রার চেয়ারম্যান জানালেন, আয়লার পর থেকে এপর্যন্ত অন্তত ১৫ শতাংশ মানুষ এলাকা ছেড়ে শহর কিংবা অন্যান্য এলাকায় চলে গেছে৻ বাঁধ যদি সহসা না হয় এবং দু`এক বছরের মধ্যে আবারো যদি একটা ঝড় হয় ? এ প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থেকে মহসিন রেজা বললেন, এ এলাকায় তখন হয়ত আর বসবাস করা যাবে না৻
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা
No comments:
Post a Comment