Saturday, February 13, 2010

নোনা জমি আঁকড়ে বেঁচে আছেন কৃষক

Biponno Banner

জোয়ার ভাটায় ক্ষতবিক্ষত উপকূল
বাংলাদেশের উপকূলে গত দু বছরে পর পর দুটো ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড় বয়ে গেছে৷ ২০০৭ এর নভেম্বরে সিডর, আর তার ছয়মাসের মাথায় আয়লা৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন এসব ঝড়-জলোচ্ছ্বাস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান একটি উপসর্গ৷ উপর্যূপরি এসব প্রাকৃতিক দূর্যোগ কতটা বিপন্ন করে তুলেছে উপকূলের বাসিন্দাদের ? 
কয়রার সবচেয়ে কাছের বড় শহর খুলনা৷ শহরের উপকন্ঠে পতিত এক জমিতে গোলপাতা আর বাঁশের ছাপড়া তুলে গত ছয় মাস ধরে বসবাস করছেন মোসলেম সর্দার৷
মে মাসে আয়লায় ঘরবাড়ী, জমি ডুবে যাওয়ার পর খুলনার সুন্দরবন লাগোয়া কয়রা উপজেলার বাঘালি ইউনিয়নের এই কৃষক বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছেন৷ দু ছেলে রিকশা চালিয়ে যা আয় করে তা দিয়ে দিন চলছে৻
বলছিলেন দুবিঘা জমির ওপর ভিটেবাড়ী ছিল৻ গত ছ মাস ধরে পানির নীচে৻ গরু-ছাগল, জিনিসপত্র বেঁচে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন৻
মোসলেম সর্দার জানালেন তার মত অনেকেই গ্রাম ছেড়েছেন৻ খুলনার যে এলাকায় এসে তিনি উঠেছেন, তার আশেপাশেই কয়রা ছেড়ে আসা আঠারো-কুড়ি পরিবার বসবাস করছে৻
‘অনেকে আত্মীয়দের কাছে গিয়ে আছে৻ আর যাদের আত্মীয়স্বজন নেই, তারা শহরের ফুটপাতে৻ কেউ গেছে সাতক্ষীরা, কেউ যশোর`৻
কিন্তু এখনও যারা ঘর-জমি-জিরাত আঁকড়ে কয়রায় পড়ে আছেন, তারা কেমন দিন কাটাচ্ছেন?
The road to Koyra
কয়রার একটি মাত্র রাস্তা
কয়রার উপজেলা সদর থেকে একটি মাত্র রাস্তা দিয়ে এখনও কিছুদূর হাঁটা যায়৻ অবশ্য একটু পর পরই সরু বাঁশের সাকো পেরুতে হয়৻ সাকোর নীচ দিয়ে রাস্তা ভেঙ্গে খাল হয়ে গেছে৻
রাস্তা ধরে যেতে যেতে স্থানীয় সাংবাদিক মতিয়ার রহমান জানালেন, কয়রার দু দিকে দুটো নদী -- শাকবাড়িয়া এবং কপোতাক্ষ৻ আয়লাতে ঐ দুটো নদী মোট ২০ জায়গায় ভেঙ্গে কয়রার মোট সাতটির ভেতর ছটি ইউনিয়নই পুরো তলিয়ে গেছে৻
ঝড়ের ছ মাস পরেও সেই প্লাবন অব্যাহত৷ দিনে দুবার লবণ পানির জোয়ার ভাঁটা হচ্ছে৷ পানিবন্দী হয়ে রয়েছেন কয়রার প্রায় দু লক্ষ মানুষ৻ লোকজন বললেন, রাস্তার দুপাশে দিগন্ত পর্যন্ত যে নোনা পানির জলাশয় দেখা যাচ্ছে, সেগুলো ছ মাস আগেও ছিল ধানের জমি৻
কয়রা উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটারের মধ্যেই ঝিলিয়াঘাটা গ্রাম৻ দেখেই বোঝা যায় সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল৻ আধডোবা বাড়ীঘর ভাঙ্গা দুমড়ানো হলেও, প্রায় প্রতিটি বাড়ীর সামনেই ধানের গোলা চোখে পড়ে৻ চারদিকে নারকেল, সুপারী সহ ফলের গাছ ৻ অবশ্য তাল আর কিছু নারকেল গাছ বাদে সমস্ত গাছ যে শুকিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে সেটা স্পষ্ট৻
ঝিলিয়াঘাটার বটকৃষ্ণ ঢালী আদর্শ কৃষক হিসেবে খুলনা জেলার ভেতরে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলেন বছর কয়েক আগে৻ আয়লার আগে মূল সড়ক থেকে বাড়ী পর্যন্ত ইঁট বিছিয়ে রাস্তা তৈরী করে নিয়েছিলেন ৻ এখন পাঁচঁটি বাঁশ দিয়ে বানানো লম্বা সরু সাঁকো দিয়ে বাড়ীতে ঢুকতে হয় তাকে৻
হাত দিয়ে দেখালেন আশেপাশের ডুবে থাকা জমিগুলো তার৻ রাস্তায় দূরে দেখা গেল আগা মরা ছোট বড় প্রচুর ফলের গাছ৻ পাঁচশ পেয়ারা গাছের বাগান ছিল তার৻ দুশ‘র মত আম গাছ, তিনশ‘র মত কাগজী লেবুর গাছ৻
‘নোনা পানিতে সব শেষ`, বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে গেল বটকৃষ্ণ ঢালীর৻ ‘প্রতিদিন সকালে উঠে গাছগুলোকে না দেখলে শান্তি লাগত না, এখন আর তা পারিনা...কষ্ট হয়`৻
বটকৃষ্ণ ঢালীর গরু ছিল এগারটা৻ আক্ষেপ করে বললেন, ঝড়ের পর গরুগুলো যখন দিনের মত দিন পানি খেতে পারছিল না, পানির দরে বেঁচে দিতে বাধ্য হয়েছেন৻ ‘ভাবলাম ওগুলো তো অন্তত প্রাণে বাঁচুক`৻
একই কাহিনী বটকৃষ্ণ ঢালীর প্রতিবেশীদের, এবং কয়রায় ছটি ইউনিয়নের দেড় থেকে দু লক্ষ মানুষের৷ এক প্রতিবেশীর খালি বাড়ী দেখিয়ে বললেন, এরা বাড়ীঘর ছেড়ে বাগেরহাট শহরে ছেলের কাছে গিয়ে উঠেছেন৻
Another resident of Jhiliaghata, Shibani
ঝিলিয়াঘাটার আরেক বাসিন্দা শিবানী
বটকৃষ্ণের আরেক সম্পন্ন প্রতিবেশী শিবানী বললেন পরপর দু দুটো ধান করতে পারেননি তারা৻ কিভাবে চলবে, কিভাবে থাকবেন ভেবে পাচ্ছেন না৻ চোখে পানি নিয়ে বললেন, ‘হঠাত গরীব হয়ে গেছি`৻
নোনা পানিতে কাহিল হয়ে গেছেন কয়রার মানুষ৻ দুটো ফসল হয়নি৻ আবার কবে হবে জানেন না৻ খাওয়ার পানির কষ্ট সবচেয়ে বেশী৻ পাঁচ দশ মাইল ভেঙ্গে নৌকোয় করে উপজেলা সদর থেকে খাবার পানি আনতে দশ থেকে পঁচিশ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে প্রতিদিন৻
স্থানীয় কপোতাক্ষ কলেজের শিক্ষকরা বললেন আয়লার পর থেকে অর্ধেক ছাত্র ক্লাসে আসছে না৷
কতদিন রাস্তা আর বাঁধের ওপর থাকতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে৻
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ৻ তিনি মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে সমুদ্রের উপরিতল স্ফীত হয়ে বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণাঞ্চল ডুবে যাবে, এ ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয়৻
‘আমি বরঞ্চ বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছি`৻ তার মতে, ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা বেড়ী বাঁধগুলো বাড়তি চাপের ঢেউয়ের ধাক্কায় হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, যদি সেগুলো ঠিক করা না হয়৻ সেক্ষেত্রে পানি বাঁধের ভেতরে ঢোকার পর, সেচ করে তা সরিয়ে দেয়া গেলেও, তা রেখে যাবে লবণ৻
‘ফলে প্রতিটি বাঁধের ভেতরে কৃষির জন্য এক একটি মরনফাঁদ তৈরী হবে, যার ভেতরে মানুষ হয়ত থাকতে পারবে, কিন্তু সেখানে কৃষিকাজ করা যাবে না বছরের পর বছর`৻
কয়রার অবস্থাটা এখন সরকমই৻ ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ দেয়ার পর প্রায় লবণমুক্ত হয়ে উঠেছিল সুন্দরবন লাগোয়া কয়রা ৷
ধান, মাছ, সব্জী, ফলমূলে উদ্বৃত্ত হয়ে উঠেছিল এই অঞ্চল৷ কিন্তু একসময়ের উর্বর ধানের জমিগুলো এখন লবণ পানির হ্রদ৷
কয়রার উপজেলা চেয়ারম্যান মহসিন রেজার বা উপজেলা প্রশাসনের খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই কিভাবে, কতদিনে ভাঙ্গা বাঁধের মেরামত হবে, কতদিনে লবণ পানি সরে এলাকায় আবার চাষাবাদ হবে৻
মহসিন রেজা বললেন যে এখন বাঁধ নির্মাণই তাদের সবচেয়ে জরুরী কাজ৻ কারণ পানি না নামলে কিছুই করা যাবে না৻
"Many communities might just give up, and leave"
"মানুষ এমন পরিস্থিতিতে টিঁকে নাও থাকতে পারে"
কয়রার চেয়ারম্যান জানালেন, আয়লার পর থেকে এপর্যন্ত অন্তত ১৫ শতাংশ মানুষ এলাকা ছেড়ে শহর কিংবা অন্যান্য এলাকায় চলে গেছে৻ বাঁধ যদি সহসা না হয় এবং দু`এক বছরের মধ্যে আবারো যদি একটা ঝড় হয় ? এ প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থেকে মহসিন রেজা বললেন, এ এলাকায় তখন হয়ত আর বসবাস করা যাবে না৻
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা

No comments:

Post a Comment