‘বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন কমাতেই হবে’ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে মতৈক্যের একটি জায়গা তৈরি হয়েছে। ধনী-গরিব সব দেশের পক্ষ থেকে একটি কথাই উঠছে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২০৫০ সালের মধ্যে গড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হলে শতকরা ৮০ ভাগ কার্বন নির্গমন কমাতেই হবে। এ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যত আন্তর্জাতিক সভা হয়েছে, তার মধ্যে এই সিদ্ধান্তই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কে কমাবে? এবং কীভাবে কমাবে? সেই প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। তবে এ কথাও আমরা সবাই জানি, কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য শিল্পোন্নত দেশের তথাকথিত উন্নয়ন বা অতি-উন্নয়ন এবং পৃথিবীর সব দেশেরই ধনীদের বিলাসী জীবনযাত্রার ধরন দায়ী। এই জীবনযাপনের সব মাধ্যম জ্বালানিনির্ভর, যার মধ্যে এই কার্বন নির্গমনের সব উপকরণ রয়ে গেছে।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে বর্তমানে জাতিসংঘের যে জলবায়ু সন্মেলন চলছে, তার কারণেও বাতাসে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ বাড়বে, কারণ ১৯২টি দেশের কয়েক হাজার প্রতিনিধি উড়োজাহাজে করে যাবেন, অনেক গাড়ি চলবে, বাতি জ্বলবে আর খরচ হবে কাগজ, হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট বের হবে প্রতিদিন। এসব কূটতর্ক মনে হতে পারে, তবে এ ধরনের সম্মেলনের এই দিকটা না বললেই নয়। তাই বলে সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করলে ভালো কিছু হবে, তা বলছি না।
পৃথিবীর ধনী ও তথাকথিত শিল্পোন্নত দেশের ধনী মানুষের জীবনযাত্রা কী পরিমাণ ক্ষতিকর, তা এই জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনাতেই বোঝা যায়। আমরাও শিল্পোন্নত দেশের অনুকরণে শিক্ষিত হতে গিয়ে শিখেছি, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’—এখন তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ‘লেখাপড়া করে যে, কার্বন নির্গমন করে সে।’ কৃষকের জ্ঞাননির্ভর ও প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর কৃষি বাদ দিয়ে জ্বালানিনির্ভর কৃষির প্রবর্তন করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থার পরামর্শে। কৃষি মানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচযন্ত্র দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা, ধান কাটার জন্য যন্ত্রের ব্যবহার, ধান ভানার জন্য রাইস মিল—সবই জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। ফলে ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থায় খাদ্য উত্পাদনও হয়ে গেছে পরিবেশ ধ্বংসের কারণ। সভ্যতা আমাদের পরিবেশবান্ধব হতে শেখায়নি, শিখিয়েছে পরিবেশ ধ্বংস করতে। অনেকে বলবেন, আমরা প্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নয়নের বিরোধিতা করছি। আসলে মানুষের কল্যাণ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রযুক্তি খুব কদর পায়নি, পেয়েছে মুনাফা অর্জনকারী ও পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রযুক্তি। কাজেই আমাদের সমালোচনা সেই প্রযুক্তির বিরুদ্ধেই।
ধনীদের জীবনযাত্রার গরমে উত্তর মেরুর নিষ্পাপ হিমবাহ বা গ্লেসিয়ার আর টিকে থাকতে পারছে না। সেগুলো গলে যাচ্ছে। আগে শীতকালে গ্লেসিয়ার ছড়িয়ে পড়ত, গরমকালে ছোট হয়ে আসত। এই গ্লেসিয়ারের অবস্থা দেখে বিশ্বের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে কি না, তা ধারণা করা যায়। ১৯৮০ সাল থেকে গ্লেসিয়ারের সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নজরে আসতে শুরু করে। এতে উন্নত বিশ্ব একটু চিন্তিত হয়ে উঠেছে। গ্লেসিয়ার না গলে যদি শুধু সমুদ্রের পানি বেড়ে যেত, তাহলে এত বেশি হইচই হতো কি না সন্দেহ আছে। কারণ, সেটা মূলত বাংলাদেশের মতো সমুদ্রপারের গরিব দেশের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
এদিকে আমাদের দেশের কাছাকাছি বরফ গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে হিমালয়ের চূড়ায়। সেখানে বরফ সময়ের আগেই গলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের নদীতে পানি অস্বাভাবিকভাবে এবং অসময়ে বাড়ছে। শীত, গরম ও বর্ষাকাল ঠিকমতো আর বোঝা যাচ্ছে না। এটা বড়ই যন্ত্রণার।
বাংলাদেশকে বিশ্বের পরিবেশসচেতন মানুষ এখন খুব চেনে। তারা বলে, ওহ্, বাংলাদেশ, তোমরা তো সমুদ্রের পানিতে ডুবে মরবে। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। কিন্তু অনেকে যেটা দেখছেন না তা হচ্ছে, সমুদ্র যেমন রাগে ফুঁসছে, তেমনি হিমালয়ের অভিমানও কম নয়। বাংলাদেশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র মিশে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। জাতিসংঘের জলবায়ুসংক্রান্ত প্রতিবেদনে (Big melt threatens millions, says UN, People & the Planet. June 4, 2007) হিমালয়ের গ্লেসিয়ার গলে যাওয়ার ফলে এশিয়ার; বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার, নদীর উত্স ২০৩৫ সাল অর্থাত্ মাত্র ২০ থেকে ২১ বছরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশসহ ভারত, তিব্বত, নেপাল, পাকিস্তান ও মিয়ানমারে আগামী কয়েক দশকে বন্যা ও খরার ঘটনা বেড়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা এমনিতেই বাড়বে, তার ওপর যোগ হবে হিমালয়ের বরফগলা পানি। বাংলাদেশের মাথার ওপরে এবং পায়ের তলায় সব দিক থেকে আঘাত আসবে।
কোপেনহেগেনে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি নতুন চুক্তি হওয়ার কথা। বর্তমানে যে চুক্তি চলছে, অর্থাত্ কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হয়ে যাবে। কাজেই বিশ্বে তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য নতুনভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চুক্তি হওয়ার কথা। আর তখনই গোল বাধছে। যাদের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে, তারা নিজেদের জীবনযাত্রা পরিবর্তনের খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হয় না; বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা সাড়া দিচ্ছে না। তাদের জীবাশ্মনির্ভর জীবনযাত্রা পরিবর্তন না করেই আলোচনার মোড় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। তারা ভোগ কমানোর কথা যত না বলছে, তার চেয়ে বেশি আঙুল তুলে দেখানোর চেষ্টা করছে যে আসলে গরিব মানুষের সংখ্যাই দায়ী। সে কারণে তড়িঘড়ি করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন, ২০০৯ প্রকাশ করে বসেছে। কোনো প্রকার গণনা ছাড়াই অঙ্ক কষে বিশ্বের জনসংখ্যা সাত বিলিয়ন হয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তারা আরও বলছে, আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য জনসংখ্যাও একটি বিষয় হিসেবে আসা উচিত। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার প্রভাব নিয়ে খুব বড় ধরনের যুক্তি তাদের পক্ষে নেই বলে তারা আভাসে-ইঙ্গিতে তা তুলছে। তারা ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’ কথাটি উচ্চারণ না করে হালকাভাবে ‘পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি’ করা উচিত বলে পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে একটু চালাকি আছে। বলা বাহুল্য, এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজটি গরিবদের ওপরই ঘটবে, যেমন অতীতে ঘটেছে। ভোগই যদি কার্বন নির্গমনের প্রধান কারণ হয়, তাহলে গরিব দেশের গরিব মানুষ যা ভোগ করে, তা ধনীদের ভোগের ধারেকাছেও নেই। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ১৯৯৮ ওভারভিউ, ধনী-গরিবের ভোগের বিপুল ব্যবধান তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়েছে, মাত্র ২০ শতাংশ ধনী মানুষ ৮৬ শতাংশ ভোগ করে আর সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ গরিব মানুষ মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ ভোগ করে। এই ২০ শতাংশ ধনীরা ৪৫ শতাংশ মাছ-মাংস, ৫৮ শতাংশ জ্বালানি, ৮৪ শতাংশ কাগজ এবং ৮৭ শতাংশ গাড়ির ব্যবহার করে। এর বিপরীতে মাত্র ৫ শতাংশ মাছ-মাংস, ৪ শতাংশ জ্বালানি, ১ দশমিক ১ শতাংশ কাগজ এবং ১ শতাংশ গাড়ি ব্যবহার করে। তাহলে এই গরিব মানুষগুলোকে দুনিয়া থেকে একেবারে সরিয়ে দিলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ১ শতাংশও উন্নতি করা যাবে না। অথচ ধনীরা একটু দয়া করে তাদের ভোগের মাত্রা কমিয়ে দিলে অনেক পার্থক্য বোঝা যাবে, এই কথা একটি শিশুও হিসাব করে বুঝবে। কিন্তু তবুও কেন তৃতীয় বিশ্বের জনসংখ্যার দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে? এর কারণ, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই এখন ধনী দেশের জীবনযাত্রার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ধনী দেশের সরকার এ ব্যাপারে খুব একটা দায়িত্ব নিতে চায় না বলে ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এবং এই নন্দ ঘোষ আর কেউ নয়, আমাদের গরিব মানুষ। দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর কী হতে পারে? বিশ্ব জনসংখ্যা রিপোর্ট, ২০০৯-এ আরও কারসাজি আছে। সেটা হচ্ছে, নারীদের সম্পৃক্ত করে প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছে। এ কথা সত্যি যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাচ্ছে, এতে গরিব দেশের গরিব মানুষ নিত্য বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, গত দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর ২১ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ৯৮ শতাংশ দুর্যোগই জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী মানুষের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বেড়েছে। জনসংখ্যা প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে প্রকাশ করতে গিয়ে স্থানীয় ইউএনএফপিএ প্রতিনিধি বলেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীদেরই খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কথাটি মিথ্যে নয়। তিনি সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশে দুটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সিডর ২০০৭ এবং আইলার ২০০৯-এর কথা উল্লেখ করেন এবং মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দেন। কিন্তু এর সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনার সম্পর্কটা কোথায়? পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির মাধ্যমে সন্তান জন্মদান কমানো কিংবা বন্ধ করা যাবে। অর্থাত্ সিডর বা আইলা হলে যে সন্তান জন্মায়নি, তার তো কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু যারা ইতিমধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের বাঁচানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনা কতটা সহায়ক হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত না করে বিদেশ থেকে আমদানি করা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নারীর শরীরে ঢুকিয়ে দিলে তার স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হবে, সে দায়িত্ব কে নেবে? জন্মনিয়ন্ত্রণ করা না-করা নারীর নিজের বিবেচনায়ই হওয়া উচিত, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করে জটিলতা বাড়ানোর কোনো দরকার নেই।
বাংলাদেশে ধনীদের একটি বড় অংশ ঢাকা শহরে বাস করে। তাঁদের ভোগের অবস্থা দেখলেই আমরা আন্দাজ করতে পারি, বিশ্বের ধনীদের কী অবস্থা। ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি যে যানজটের সৃষ্টি করছে, তার চেয়ে বেশি করছে বাতাসে কার্বন নির্গমন ও পরিবেশদূষণ। যানজটের সমস্যা ট্রাফিক সিগন্যালের নতুন নিয়মকানুন করে হয়তো ঠিক করা সম্ভব, কিন্তু একটি গাড়িতে মাত্র একজন কি-দুজন চড়বে বলে গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আনা না হলে কার্বন-জট ঠেকানো যাবে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সংসদে কিংবা উপজেলা পরিষদে যে জনপ্রতিনিধিরা যাচ্ছেন, তাঁদের জন্যও বিশেষ গাড়ি আমদানি করতে হচ্ছে। আমি অনেক আগে লিখেছিলাম (প্রথম আলোতেই), গাড়ির পরিবার পরিকল্পনা চাই, আজও বলছি, মানুষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যদি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি করতে হয়, তাহলে গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চাই বিশেষ পরিকল্পনা। কার্বন নির্গমন ঠেকানোর জন্য এটাই হবে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। বাংলাদেশে আমরা এখনো জলবায়ু মোকাবিলায় নিজস্ব পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারি। এর আগে আমাদের প্রতি দোষারোপ করার চেষ্টা ঠেকাতে হবে। যারা দায়ী, সেই ধনী দেশকেই কার্বন নির্গমন কমানোর বেশির ভাগ দায়িত্ব নিতে হবে। সমস্যা যেখান থেকে শুরু, সমাধান সেখান থেকেই হতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, তাং ১৩-১২-২০০৯
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে বর্তমানে জাতিসংঘের যে জলবায়ু সন্মেলন চলছে, তার কারণেও বাতাসে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ বাড়বে, কারণ ১৯২টি দেশের কয়েক হাজার প্রতিনিধি উড়োজাহাজে করে যাবেন, অনেক গাড়ি চলবে, বাতি জ্বলবে আর খরচ হবে কাগজ, হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট বের হবে প্রতিদিন। এসব কূটতর্ক মনে হতে পারে, তবে এ ধরনের সম্মেলনের এই দিকটা না বললেই নয়। তাই বলে সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করলে ভালো কিছু হবে, তা বলছি না।
পৃথিবীর ধনী ও তথাকথিত শিল্পোন্নত দেশের ধনী মানুষের জীবনযাত্রা কী পরিমাণ ক্ষতিকর, তা এই জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনাতেই বোঝা যায়। আমরাও শিল্পোন্নত দেশের অনুকরণে শিক্ষিত হতে গিয়ে শিখেছি, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’—এখন তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ‘লেখাপড়া করে যে, কার্বন নির্গমন করে সে।’ কৃষকের জ্ঞাননির্ভর ও প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর কৃষি বাদ দিয়ে জ্বালানিনির্ভর কৃষির প্রবর্তন করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থার পরামর্শে। কৃষি মানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচযন্ত্র দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তোলা, ধান কাটার জন্য যন্ত্রের ব্যবহার, ধান ভানার জন্য রাইস মিল—সবই জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। ফলে ফ্যাক্টরি-ব্যবস্থায় খাদ্য উত্পাদনও হয়ে গেছে পরিবেশ ধ্বংসের কারণ। সভ্যতা আমাদের পরিবেশবান্ধব হতে শেখায়নি, শিখিয়েছে পরিবেশ ধ্বংস করতে। অনেকে বলবেন, আমরা প্রযুক্তির বিকাশ ও উন্নয়নের বিরোধিতা করছি। আসলে মানুষের কল্যাণ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রযুক্তি খুব কদর পায়নি, পেয়েছে মুনাফা অর্জনকারী ও পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রযুক্তি। কাজেই আমাদের সমালোচনা সেই প্রযুক্তির বিরুদ্ধেই।
ধনীদের জীবনযাত্রার গরমে উত্তর মেরুর নিষ্পাপ হিমবাহ বা গ্লেসিয়ার আর টিকে থাকতে পারছে না। সেগুলো গলে যাচ্ছে। আগে শীতকালে গ্লেসিয়ার ছড়িয়ে পড়ত, গরমকালে ছোট হয়ে আসত। এই গ্লেসিয়ারের অবস্থা দেখে বিশ্বের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে কি না, তা ধারণা করা যায়। ১৯৮০ সাল থেকে গ্লেসিয়ারের সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নজরে আসতে শুরু করে। এতে উন্নত বিশ্ব একটু চিন্তিত হয়ে উঠেছে। গ্লেসিয়ার না গলে যদি শুধু সমুদ্রের পানি বেড়ে যেত, তাহলে এত বেশি হইচই হতো কি না সন্দেহ আছে। কারণ, সেটা মূলত বাংলাদেশের মতো সমুদ্রপারের গরিব দেশের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
এদিকে আমাদের দেশের কাছাকাছি বরফ গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে হিমালয়ের চূড়ায়। সেখানে বরফ সময়ের আগেই গলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের নদীতে পানি অস্বাভাবিকভাবে এবং অসময়ে বাড়ছে। শীত, গরম ও বর্ষাকাল ঠিকমতো আর বোঝা যাচ্ছে না। এটা বড়ই যন্ত্রণার।
বাংলাদেশকে বিশ্বের পরিবেশসচেতন মানুষ এখন খুব চেনে। তারা বলে, ওহ্, বাংলাদেশ, তোমরা তো সমুদ্রের পানিতে ডুবে মরবে। বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। কিন্তু অনেকে যেটা দেখছেন না তা হচ্ছে, সমুদ্র যেমন রাগে ফুঁসছে, তেমনি হিমালয়ের অভিমানও কম নয়। বাংলাদেশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র মিশে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। জাতিসংঘের জলবায়ুসংক্রান্ত প্রতিবেদনে (Big melt threatens millions, says UN, People & the Planet. June 4, 2007) হিমালয়ের গ্লেসিয়ার গলে যাওয়ার ফলে এশিয়ার; বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার, নদীর উত্স ২০৩৫ সাল অর্থাত্ মাত্র ২০ থেকে ২১ বছরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশসহ ভারত, তিব্বত, নেপাল, পাকিস্তান ও মিয়ানমারে আগামী কয়েক দশকে বন্যা ও খরার ঘটনা বেড়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা এমনিতেই বাড়বে, তার ওপর যোগ হবে হিমালয়ের বরফগলা পানি। বাংলাদেশের মাথার ওপরে এবং পায়ের তলায় সব দিক থেকে আঘাত আসবে।
কোপেনহেগেনে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য একটি নতুন চুক্তি হওয়ার কথা। বর্তমানে যে চুক্তি চলছে, অর্থাত্ কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হয়ে যাবে। কাজেই বিশ্বে তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য নতুনভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে চুক্তি হওয়ার কথা। আর তখনই গোল বাধছে। যাদের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে, তারা নিজেদের জীবনযাত্রা পরিবর্তনের খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হয় না; বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা সাড়া দিচ্ছে না। তাদের জীবাশ্মনির্ভর জীবনযাত্রা পরিবর্তন না করেই আলোচনার মোড় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে। তারা ভোগ কমানোর কথা যত না বলছে, তার চেয়ে বেশি আঙুল তুলে দেখানোর চেষ্টা করছে যে আসলে গরিব মানুষের সংখ্যাই দায়ী। সে কারণে তড়িঘড়ি করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন, ২০০৯ প্রকাশ করে বসেছে। কোনো প্রকার গণনা ছাড়াই অঙ্ক কষে বিশ্বের জনসংখ্যা সাত বিলিয়ন হয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তারা আরও বলছে, আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য জনসংখ্যাও একটি বিষয় হিসেবে আসা উচিত। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার প্রভাব নিয়ে খুব বড় ধরনের যুক্তি তাদের পক্ষে নেই বলে তারা আভাসে-ইঙ্গিতে তা তুলছে। তারা ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’ কথাটি উচ্চারণ না করে হালকাভাবে ‘পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি’ করা উচিত বলে পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে একটু চালাকি আছে। বলা বাহুল্য, এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজটি গরিবদের ওপরই ঘটবে, যেমন অতীতে ঘটেছে। ভোগই যদি কার্বন নির্গমনের প্রধান কারণ হয়, তাহলে গরিব দেশের গরিব মানুষ যা ভোগ করে, তা ধনীদের ভোগের ধারেকাছেও নেই। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ১৯৯৮ ওভারভিউ, ধনী-গরিবের ভোগের বিপুল ব্যবধান তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয়েছে, মাত্র ২০ শতাংশ ধনী মানুষ ৮৬ শতাংশ ভোগ করে আর সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ গরিব মানুষ মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ ভোগ করে। এই ২০ শতাংশ ধনীরা ৪৫ শতাংশ মাছ-মাংস, ৫৮ শতাংশ জ্বালানি, ৮৪ শতাংশ কাগজ এবং ৮৭ শতাংশ গাড়ির ব্যবহার করে। এর বিপরীতে মাত্র ৫ শতাংশ মাছ-মাংস, ৪ শতাংশ জ্বালানি, ১ দশমিক ১ শতাংশ কাগজ এবং ১ শতাংশ গাড়ি ব্যবহার করে। তাহলে এই গরিব মানুষগুলোকে দুনিয়া থেকে একেবারে সরিয়ে দিলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ১ শতাংশও উন্নতি করা যাবে না। অথচ ধনীরা একটু দয়া করে তাদের ভোগের মাত্রা কমিয়ে দিলে অনেক পার্থক্য বোঝা যাবে, এই কথা একটি শিশুও হিসাব করে বুঝবে। কিন্তু তবুও কেন তৃতীয় বিশ্বের জনসংখ্যার দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে? এর কারণ, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই এখন ধনী দেশের জীবনযাত্রার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ধনী দেশের সরকার এ ব্যাপারে খুব একটা দায়িত্ব নিতে চায় না বলে ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’কে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এবং এই নন্দ ঘোষ আর কেউ নয়, আমাদের গরিব মানুষ। দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর কী হতে পারে? বিশ্ব জনসংখ্যা রিপোর্ট, ২০০৯-এ আরও কারসাজি আছে। সেটা হচ্ছে, নারীদের সম্পৃক্ত করে প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছে। এ কথা সত্যি যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাচ্ছে, এতে গরিব দেশের গরিব মানুষ নিত্য বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, গত দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর ২১ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ৯৮ শতাংশ দুর্যোগই জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী মানুষের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বেড়েছে। জনসংখ্যা প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে প্রকাশ করতে গিয়ে স্থানীয় ইউএনএফপিএ প্রতিনিধি বলেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীদেরই খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কথাটি মিথ্যে নয়। তিনি সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশে দুটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সিডর ২০০৭ এবং আইলার ২০০৯-এর কথা উল্লেখ করেন এবং মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দেন। কিন্তু এর সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনার সম্পর্কটা কোথায়? পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির মাধ্যমে সন্তান জন্মদান কমানো কিংবা বন্ধ করা যাবে। অর্থাত্ সিডর বা আইলা হলে যে সন্তান জন্মায়নি, তার তো কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু যারা ইতিমধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের বাঁচানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনা কতটা সহায়ক হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত না করে বিদেশ থেকে আমদানি করা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নারীর শরীরে ঢুকিয়ে দিলে তার স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হবে, সে দায়িত্ব কে নেবে? জন্মনিয়ন্ত্রণ করা না-করা নারীর নিজের বিবেচনায়ই হওয়া উচিত, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করে জটিলতা বাড়ানোর কোনো দরকার নেই।
বাংলাদেশে ধনীদের একটি বড় অংশ ঢাকা শহরে বাস করে। তাঁদের ভোগের অবস্থা দেখলেই আমরা আন্দাজ করতে পারি, বিশ্বের ধনীদের কী অবস্থা। ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি যে যানজটের সৃষ্টি করছে, তার চেয়ে বেশি করছে বাতাসে কার্বন নির্গমন ও পরিবেশদূষণ। যানজটের সমস্যা ট্রাফিক সিগন্যালের নতুন নিয়মকানুন করে হয়তো ঠিক করা সম্ভব, কিন্তু একটি গাড়িতে মাত্র একজন কি-দুজন চড়বে বলে গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আনা না হলে কার্বন-জট ঠেকানো যাবে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সংসদে কিংবা উপজেলা পরিষদে যে জনপ্রতিনিধিরা যাচ্ছেন, তাঁদের জন্যও বিশেষ গাড়ি আমদানি করতে হচ্ছে। আমি অনেক আগে লিখেছিলাম (প্রথম আলোতেই), গাড়ির পরিবার পরিকল্পনা চাই, আজও বলছি, মানুষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যদি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি করতে হয়, তাহলে গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চাই বিশেষ পরিকল্পনা। কার্বন নির্গমন ঠেকানোর জন্য এটাই হবে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। বাংলাদেশে আমরা এখনো জলবায়ু মোকাবিলায় নিজস্ব পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারি। এর আগে আমাদের প্রতি দোষারোপ করার চেষ্টা ঠেকাতে হবে। যারা দায়ী, সেই ধনী দেশকেই কার্বন নির্গমন কমানোর বেশির ভাগ দায়িত্ব নিতে হবে। সমস্যা যেখান থেকে শুরু, সমাধান সেখান থেকেই হতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments:
Post a Comment