Thursday, February 11, 2010

প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে সুরক্ষা চাই

মানুষ প্রকৃতির ওপর দীর্ঘদিন ধরেই অত্যাচার করে আসছে। প্রকৃতি মাঝেমধ্যে তার ভাষায় এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু মানুষ এ প্রতিবাদ আমলে নেয়নি। এখন প্রকৃতি তার অমোঘ নিয়মে অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে ধেয়ে আসছে। উন্নত দেশগুলোর শিল্পোন্নয়নের ফলে যেভাবে কার্বন নিঃসরণ হয়েছে, তাতে আজ পৃথিবী হুমকির মুখে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো। কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণ করতে পারে যে বন বৃক্ষরাজি, আমরা সেই বনের বৃক্ষ নিধন করে চলেছি প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে প্রাকৃতিক জলাশয় খাল, বিল, হাওরের পানি নিষ্কাশন করে শষ্য উত্পাদন মাঠে পরিণত করেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি গভীর নলকূপ দিয়ে টেনে তুলে আনা হচ্ছে। ভূ-মাটির ওপরের পানি ধারণ করে রাখতে দেওয়া হচ্ছে না, অন্যদিকে মাটির নিচেও পানিশূন্যতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে বনাঞ্চলের অভাবে ভূ-উপরস্থ পানির অভাব, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পৃথিবীকে আরও গরম হতে সাহায্য করছে। ফলে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে। বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হচ্ছে। আবহাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতিকর পরিবর্তন হচ্ছে।
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব পড়তে আরম্ভ করেছে বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি স্টকহোমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এর প্রভাবে বাংলাদেশের দুই কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দিন বদলের কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী দেশের কৃষি এবং কৃষকের দিকে সদয় দৃষ্টি দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এবং দলমতনির্বিশেষে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ভূ-উপরস্থ পানি দিয়ে সেচব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলেছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণ করার জন্য মাটি খনন করে ছোট-বড় জলাশয় সৃষ্টি করতে।
পৃথিবীর খাদ্য পরিস্থিতির বিবেচনায় দেশের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দেশের মধ্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য উত্পাদন বাড়াতে হবে। খাদ্য উত্পাদনের জন্য যেমন জমির সর্বোত্তম ব্যবহার প্রয়োজন, তেমনি ফসল উত্পাদনের জন্য যথাসময়ে বীজ, সেচ, সার সরবরাহ আবশ্যক। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, এখনো এ অঞ্চলে গভীর নলকূপের পানি দিয়ে সেচব্যবস্থা করা হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে ১২ হাজার গভীরে নলকূপের সাহায্যে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচব্যবস্থা সচল রেখেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে এ অঞ্চলে পানির স্তর প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে।
রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে দেশের অন্য অংশের চেয়ে বৃষ্টিপাত অনেক কম। বরেন্দ্র অঞ্চলের সমভূমির উচ্চতা ১২ মিটার হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু এলাকার উচ্চতা ৪৫ মিটার পর্যন্ত রয়েছে। তাই বরেন্দ্র অঞ্চল বন্যামুক্ত। বৃষ্টি কম এবং বন্যামুক্ত অঞ্চল হওয়ার কারণে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানি পুনর্ভরণ হচ্ছে না। এ জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর লাগাতারভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে জমি শুষ্ক হচ্ছে, হ্যান্ড টিউবওয়েলে এমনকি তারা পাম্পেও পানি ওঠে না, কুয়া শুকিয়ে গেছে, পুকুরে খরা মৌসুমে পানি থাকে না। সেচকাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারের কারণে ভূমির ওপরের স্তর লৌহ ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা দূষিত হচ্ছে। ফলে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে। রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ছে। কৃষকের ব্যয় বাড়ছে। আর সবচেয়ে ক্ষতি করছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বরেন্দ্র অঞ্চলে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে।
পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য, ঊষর বরেন্দ্র অঞ্চলের উষ্ণতা স্বাভাবিক করার জন্য, কৃষকের কাছে স্বল্প মূল্যে এবং সার্বক্ষণিক সেচের পানি সরবরাহ করার জন্য, বরেন্দ্র অঞ্চলের জমি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থমুক্ত রাখার জন্য, কৃষি উত্পাদন ব্যয় কৃষকের সীমার মধ্যে রাখার জন্য, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য, বন্যামুক্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে তিনটি ফসল উত্পাদনের নিশ্চয়তা নিয়ে পাউবো জাপানের জাইকার সহায়তায় পদ্মা নদীর পানি দিয়ে সেচসুবিধা দেওয়ার জন্য ‘উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পের’ প্রস্তাবনা ১৯৮৮ সালে গ্রহণ করে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ৭৪ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমি চাষাবাদ হবে ভূ-উপরস্থ পদ্মার পানির সেচ দিয়ে। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন কমবে। ভূ-গর্ভস্থ পানির আধারে পুনর্ভরণে সহায়ক হবে। ফলে পরিবেশে ভারসাম্য ফিরে আসবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ এ অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে জনসভা, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক করে আসছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের সর্বস্তরের জনগণ চায়, পদ্মার পানি দিয়ে সেচব্যবস্থা গড়ে উঠুক।
রাজশাহীতে পাউবো ২০০৮ সালের ১৮ মে দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ‘উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প’ বিষয় নিয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে আয়োজক ও বক্তাদের কথায় রাজশাহীবাসীর আশা জেগেছিল, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জানা যায়, কোনো সাহায্য সংস্থা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এই সেচ প্রকল্পটি নিয়ে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্র করছে, প্রকল্পটি যেন বাস্তবায়িত না হয়।
জলবায়ু-সংকট মোকাবিলা, মরু প্রক্রিয়াধীন, বন্যামুক্ত ঊষর বরেন্দ্র অঞ্চল গভীর নলকূপের অভিশাপমুক্ত করে পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ‘উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন রইল। আশা করি, এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে রাজশাহী সিটি মেয়র এবং এ অঞ্চলের সংসদ সদস্যরা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন।
 মো. জামাত খান: আহ্বায়ক, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ।
< লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর 19.11.2009 তারিখের সংখ্যা থেকে নেওয়া হয়েছে >

No comments:

Post a Comment