Saturday, February 20, 2010

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি শিকার নারীরা


বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের শিকারে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। এ খবর শুধু গণমাধ্যমের নয়, এর প্রমাণ মিলেছে সরেজমিনে দেখার মাধ্যমেও। আমরা জানি, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী।
নারীদের এখনো অবলা বলে মনে করা হয়, যদিও অনেক ক্ষেত্রে নারীরা বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে ব্যাপক ভূমিকা। অনেকে বলে থাকেন, পুরুষের তুলনায় নারীর শারীরিক শক্তি কম। সেই কারণেই তাদেরকে দুর্বল নারী জাতি বলে আখ্যা দেয়া হয়। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে পরিমাণ মানুষ নানা ক্ষতির শিকার হয় তার মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। তাই অনেকে বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে নারীরা। সিডর, আইলা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঝড়ের কবলে পড়ে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নারীদেরকে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে প্রকৃতির থাবার কাছে হেরে গিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র। সেদিন কাওরান বাজারে (ঢাকার) বরগুনা থেকে চলে আসা আয়শা বিবির সাথে কথা হয়। তিনি এখন কাওরান বাজারের দোকানে দোকানে কাজ করে বেড়ান। তাতে অবশ্য দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার একরকম চলে যাচ্ছে বলে জানান। স্বামী দিলদার হোসেন মাল টানার কাজ করেন। দুঃখের সাথে তারা বলেন, সিডরে আমাদের সব ভেঙে চুরে শেষ করে দিয়ে গেছে। এর আগে আমাদের যে সম্পদ ছিল তা চৌদ্দ পুরুষেও খেয়ে শেষ করতে পারতো না। সব হারিয়ে এখন আমরা পথের ফকিরের মত। জীবন এমন হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। সন্তানদের দুঃখ-কষ্টও চোখের সামনে সহ্য হয় না। কপালে যা আছে তা তো হবেই। দুশ্চিন্তা শুধু পোলাপানের জন্য।
পরিবর্তন শব্দটি হতে পারে ইতিবাচক। অভিধানও তাই বলে। তবে বর্তমান বিজ্ঞানের এ অগ্রযাত্রার দিনে যে পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি তার জন্য আমরা ভীত বা শংকিত না হয়ে পারি না। আর এটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। খোদ বিশ্বজুড়ে গবেষকরা বলেছেন, এ পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হবে নারীরা। কোপেনহেগেনে (ডেনমার্কের রাজধানী) সম্প্রতি শেষ হওয়া জলবায়ু সম্মেলনেও এমনি আভাসের কথা বলা হয়েছে। উপকূলের মানুষ বলছেন, প্রকৃতি তার স্বভাব যেন পরিবর্তন করে ফেলেছে। যখন তখন রোদ-বৃষ্টি, গরম-ঠান্ডা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মূল কারণ বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন। পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে উত্তপ্ত হচ্ছে বাংলাদেশও। উপকূলে সাগরের পানির উচ্চতা ক্রমবর্ধমান। ফলে সুন্দরবন, কক্সবাজার প্রভৃতি স্থানের একটা বিরাট অংশ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাপমাত্রা বাড়ার কারণে পানিও উত্তপ্ত হচ্ছে। এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে। মরে যাচ্ছে অনেক ধরনের গাছ, পশুপাখি, পোকা-মাকড় ইত্যাদি। পুরুষের পাশাপাশি উপকূলের নারীদের অর্থ আয়ের একটি মাধ্যম হচ্ছে সুন্দরবনের সম্পদ। এ সম্পদের মধ্যে রয়েছে কাঠ বা লাকড়ি, মাছ, মধু ইত্যাদি। গোল গাছ বা গোলগাছ বলে পরিচিত সম্পদ ক্রমেই কমে আসছে। ফলে নারীদের অর্থ আয়ের পথও ছোট হয়ে আসছে। অনেকে তাই পেটের দায়ে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন এদিকে সেদিক। আবহাওয়া বা পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে অনেকে শিকার হচ্ছেন নানা রোগ ব্যাধির। এসব নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে না বললেই চলে। তাই নানা সমস্যা থেকে উঠে আসতে তাদের খুবই বেগ পেতে হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে উদ্ধারকারীদের মধ্যে পুরুষদের উদ্ধার করার প্রবণতা বেশি থাকে। অবহেলিত থাকে নারী ও শিশুরা। যেকোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন গর্ভবতী নারীরা এ সময় তারা প্রয়োজনমত খাবার-দাবার তো পানই না, আর চিকিৎসা সেবা তো দূরে থাক। অনেকে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে পতিত হন মৃত্যুর মুখে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সূত্রে বলা হয়েছে, নানা দুর্যোগের পর যে রিলিফ, ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আসে সেগুলো থেকেও চরমভাবে বঞ্চিত হয় নারীরা।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি খারাপ প্রভাব পড়ছে ও পড়বে দরিদ্র দেশের দরিদ্র নারীদের উপর। অনেকে বলে থাকেন, এসবে নারীদের অবদান কম। আসলে কথাটা ঠিক নয়। কেননা পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও আজ পরিবেশ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। যেমন অনেক প্রকৃতি ও পরিবেশবিজ্ঞানী নারী। নারী সংক্রান্ত নানা প্রতিষ্ঠান বা সংঘ, সমিতি ইত্যাদি রয়েছে। নানা দুর্যোগে তাদেরকেও পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে যেতে দেখা যায় নিঃস্বার্থভাবে।
কোনো ধরনের দুর্যোগ দেখা দিলে সংসারে নারীর কাজ যেন বেড়ে যায়। তাকে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যদিয়ে খাদ্য, জ্বালানি ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হয়। বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা করা দরকার। অনেক সময় ঘরে মেয়ে শিশুদের ঘরের কাজে বেশি মনোযোগী হতে হয়। এসবের চাপে অনেক সময় লেখাপড়ার মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। এ সময় বাল্যবিয়ের প্রবণতাও বেড়ে যায়। কারণ এখন অনেক অভিভাবকই মেয়েদেরকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। কারণ পরিবারের সচ্ছলতাও অনেকাংশে কমে যায়। আসলে দারিদ্র্য যে মানুষকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় তা অনেকেই বুঝতে পারেন না, বুঝার কথাও না। দারিদ্রে্যর কারণে ঘর ভাঙা বা আত্মহত্যার মত ঘটনার কথাও আমরা শুনি। এসব খবর বড়ই দুঃখের। আসলে ছেলে হোক মেয়ে হোক সবাই তো সম্পদ, যদি সম্পদে পরিণত হওয়ার সুযোগ থাকে বা সুযোগ করে দেয়া হয়। আসলে বড় হওয়ার মত প্রতিভা সকল শিশুর মনে থাকে। এটির প্রকাশ বা বিকাশ ঘটে কোনো এক সময়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা বা এর বিস্তৃতির কারণে দেশে শুধু নয় বরং বিশ্বেও ফসল উৎপাদন কমবেশি কমে গেছে। অনেক স্থানে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে।
তাতে করে পুষ্টি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নারীরা। প্রশাসনিকভাবে বলা হয়ে থাকে, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তার জ্ঞান নারীদের আছে। জলবায়ু পরিকল্পনা বিষয়ক নীতি, পরিকল্পনা, কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে নারীকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয় দেখা দিলে অনেক সময় নারীরা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদি ঝুঁকিরও শিকার হন। এ যেন বিপদের উপর বিপদ। এসব সমস্যা থেকে নারীদের বাঁচাতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসা উচিত নিঃস্বার্থভাবে।

No comments:

Post a Comment